বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন শদ আবু সাঈদ। তার মৃত্যুর মূহুর্ত থেকে ফেটে পরে সারা বাংলাদেশর আপামর ছাত্রজনতা। মৃত্যুর আগে ফেসবুকে আবু সাঈদ শামসুজ্জোহার সমাধিফলকের ছবি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার, স্যার! আপনার সামসময়িক সময়ে যারা ছিল, সবাই তো মরে গেছে, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত।’
আবু সাইদ ১৭ জুলাই পরিবারের সাথে দেখা করতে যেতে চেয়েছিলেন। তবে ঠিকই দেখা হলো পরিবারে নিথর দেহের সাথে। আবু সাইদের ডাকে ২০ কোটি জনগণ পেয়েছে নতুন বাংলাদেশ। ছোটবেলা থেকে আবু সাইদ শুধু একা বাঁচতে চায়নি। সবাইকে নিয়ে তিনি দেশ বাঁচাতে চেয়েছিলেন।
পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামে দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। পিতার নাম মকবুল হোসেন এবং মাতা মনোয়ারা বেগম। নয় ভাই-বোনের অভাবের সংসারে কেবল আবু সাঈদেরই পড়াশোনা চালিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবেন। তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ভর্তি হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। তিনি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। আবু সাঈদ পড়াশোনায় ছিলেন অনেক মেধাবি। অনার্স চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন আবু সাঈদ। সিজিপিএ ৩.৩০ পেয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১৪তম স্থান অধিকার করেছেন। ৬৯ জন শিক্ষার্থীর মাঝে আবু সাঈদ মেধাতালিকায় ১৪তম স্থান অধিকার করেছে।
শহিদ আবু সাঈদের ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা ছিল গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনের মধ্যে । ১১ জুলাই ক্যাম্পাসে মিছিল করার পর ১২ জুলাই ছিল আবু সাঈদের নিবন্ধন লিখিত পরীক্ষা। এতে দেখা গেছে, শহিদ আবু সাঈদ ইবতেদায়ী সহকারী শিক্ষক হিসেবে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছেন।
৬ জুন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝটিকা মিছিলের মধ্যে দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। প্রথম থেকে আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন শহিদ আবু সাঈদ। এরপর ৩০ জুন বিক্ষোভ ও ১ জুলাই মিডিয়া চত্ত্বরে আবু সাঈদসহ অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীরা সমবেত হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন আবু সাঈদ। আবু সাঈদ সিনিয়র হওয়ার কারণে নেতৃত্বের দায়িত্বটা তাকেই নিতে হয়।
প্রতিটি আন্দোলনে আবু সাঈদ সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবু সাঈদ আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে টার্গেট করে। ১১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বাইরে বের হওয়ার সময় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন আবু সাঈদসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা।
১২ তারিখ বিকালে স্বাধীনতা স্মারকে মিটিং করার সময় আবু সাঈদ সকল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, কারা আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে মরতে প্রস্তুত আছো- এদিকে আসো যারা সামনে বেরিকেড দিয়ে আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা দেবে।
১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং রংপুরের অন্যান্য স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনটি লালবাগ অভিমুখ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ শিক্ষার্থীদেরকে বাধা প্রদান করে এক পর্যায়ে পুলিশ এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয়। পুলিশ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে টিয়ারশেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং শিক্ষার্থীদের ছাত্রভঙ্গ করে দেয়। এক পর্যায়েই পাঁচজন পুলিশ নিরস্র আবু সাঈদের ওপর স্টিলের লাঠি ও কাঠের লাঠি দিয়ে আবু সাঈদের মাথায় আঘাত শুরু করে।
পুলিশ আবু সাঈদকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার কারণে আবু সাঈদের মাথা থেকে অঝরে রক্ত ঝরে এবং তাকে লাঠি দিয়ে মারার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট হতে একজন পুলিশ আবু সাঈদকে তাক করে রিভলবার দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করে। এরপর পুনরায় শিক্ষার্থীরা ১নং গেইট নিয়ন্ত্রণ নিলে পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ ক্যাম্পাসের গেইটের ভেতরে প্রবেশ করে এবং গেটের ভেতর থেকে পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড শিক্ষার্থীদের তাক করে নিক্ষেপ করে। এর পাশাপাশি বিদ্যালয়ের কর্মচারী-কর্মকর্তাবৃন্দ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে গালমন্দ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
আহত আবু সাঈদ পুলিশকে উদ্দেশ্য করে শুট মি, শুট মি চিৎকার করে। এক পর্যায়ে পুলিশ ভেতর থেকে গুলি, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড মারতে মারতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেট দখল নেয়। শিক্ষার্থীরা আক্রমণের মুখ থেকে সরে গেলেও আবু সাঈদ সরে যায়নি। পুলিশের আক্রমণের এক পর্যায়ে আবু সাঈদ পুলিশের দিকে নিজের বুক দুই হাত মেলে প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেট হতে এক পুলিশ সদস্য আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি আবু সাঈদের পেটে লাগলে সে ঝাঁকুনি খেয়ে কিছু বুঝতে না পেরে পুনরায় নিজের হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং সেই মুহুর্তে পুলিশ সদস্য পুনরায় তাকে পরপর ২ রাউন্ড গুলি করলে সে পড়ে যায়।
কিছুক্ষণ পরে কয়েকজন শিক্ষার্থী তাকে ধরে তুলে আনার সময় পুনরায় পড়ে যায়। তারপর ৪-৫ জন শিক্ষার্থী তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে পুলিশ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে করে পুনরায় গুলি করে। আবু সাঈদকে রংপুর মেডিকেল কলেজে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
আবু সাঈদকে নিয়ে ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহ্সীনা আহ্সান বলেন, আবু সাঈদের ফাইনাল পরীক্ষার খাতাটি দেখছিলাম। নম্বরপত্র জমা দিতে যাব; এমন সময় টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম আমার ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ তাকে গুলি করছে আর সে রাস্তায় পড়ে যায়, আবার ওঠে দাঁড়ায়। আবারো গুলি করলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। পরক্ষণেই খবর পেলাম আবু সাঈদ আর নেই, সে শহিদ হয়েছে।
আবু সাঈদকে আমি ছাত্র হিসেবে পেয়ে গর্ব বোধ করি। সে শুধু আমাদের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের গৌরব ও অহংকার। সে আমাদের জাতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আবু সাঈদ ছিল খুবই বিচক্ষণ ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। শুনেছি, আবু সাঈদের জীবনের স্বপ্ন ছিল বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া এবং সেটা মেধার ওপর ভিত্তি করেই। তাই যখন সে মেধার যুদ্ধে বৈষম্য দেখেছিল, সেটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি।
সাধারণ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য বৈষম্য আর অনিয়মের বিরুদ্ধে নিজের বুক টান করে দাঁড়িয়ে যায় হায়েনাদের সামনে। সেই হিংস্র হায়েনারা শেষ পর্যন্ত চালায় তার বুকে আর আবু সাঈদ নিজের মূল্যবান জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে অন্যায়ের সামনে মাথানত করার জাতি আমরা নই। আমি গর্বিত এমন একজন বীর শহিদের শিক্ষক হতে পেরেছি।
আবু সাঈদকে আবেগের সাথে স্মরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. শওকাত আলী বলেন, আবু সাঈদকে আমাদের দেশের প্রত্যেকটি মানুষ আবেগের সাথে স্মরণ করে। আমরা আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি আবু সাঈদ হত্যার আসামিরা আইনের আওতায় আসবে। আমরা চাই আবু সাঈদ হত্যার মতো ঘটনা এই ক্যাম্পাসসহ দেশের সকল ক্যাম্পাসে যেন আর না ঘটে। আবু সাঈদের ক্যাম্পাসে যেন শান্তির, শৃঙ্খলা, গবেষণা, উন্নয়ন বজায় থাকে; এদিকে আমরা মনোযোগ দিয়েছি।
আবু সাঈদের পরিবার ও শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে তার নামে একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নম্বর গেইটটি শহিদ ‘শহিদ আবু সাঈদ গেইট’ নামকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ ছাড়া শহিদ আবু সাঈদের ছোট বোন সুমি খাতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভাইয়ের ইংরেজি বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবু সাঈদের নামে বৃত্তি চালু করা হবে।
কেকে/এএম