রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনসাধারণের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও এসব অপরাধ কোনোভাবেই কমছে না। চলতি মাসেই একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, বেড়েছে নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। তথ্য অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের একাধিক সাবেক এমপি, মেয়র ও কাউন্সিলর। তারা বিদেশে বসে অপরাধীদের অর্থায়ন ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তাদের পরিকল্পনায় একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে, যারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
সূত্র বলছে, রাজধানীর উত্তরা ও আশপাশের এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আর এসব অপরাধে জড়িত রয়েছে উত্তরা আব্দুল্লাপুর এলাকার পরিবহন মাফিয়া নুরু ও তার ভাই কিশোর গ্যাং লিডার হুমায়ুনের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আফসার খান ও তার পলাতক ভাতিজা ছাত্রলীগ নেতা সালমান খান প্রান্তের প্রত্যক্ষ মদদে উত্তরায় সক্রিয় রয়েছে একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এর বাইরেও গাজীপুরের সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম ও যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের অর্থায়নে নুরু-হুমায়ুনের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্য, আব্দুল্লাহপুর, জসিমউদ্দিন, হাউজ বিল্ডিং, পঞ্চবটি ও বিভিন্ন সেক্টরে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যার সঙ্গে পরিবহন সেক্টরের সন্ত্রাসীদের সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গেল ছয় মাসে রাজধানীতে খুনের ঘটনা ঘটেছে প্রায় আড়াইশ। চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির সংখ্যা ৭৭২টি। এর মধ্যে রাতের আঁধারে সংঘটিত অপরাধের হার সবচেয়ে বেশি। গত রোববার রাজধানীর বনশ্রীতে নিজ বাসার সামনে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে আহত হন। তার কাছ থেকে ২০০ ভরি স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। একই রাতে মোহাম্মদপুরে চাপাতি হাতে একদল ছিনতাইকারী রিকশা থামিয়ে ছিনতাই করে। ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার জিরাবোতে নিজ বাড়িতে ডাকাতদের হামলায় আহত হন অভিনয়শিল্পী আজিজুর রহমান আজাদ। যশোরের শার্শায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে এক ব্যবসায়ী নিহত হন। রাজশাহীগামী একটি বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। রংপুরের মিঠাপুকুরে ফুল কুড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় এক স্কুলছাত্রী। অন্যদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য এক নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরায় দুই ছিনতাইকারীকে ধরে উত্তেজিত জনতা ফুটওভার ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখে। উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে এই ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। একই দিন সন্ধ্যায় উত্তরার আব্দুল্লাহপুর এলাকায়ও দুই ছিনতাইকারীকে ধরে গণপিটুনি দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। জনগণকে বলব আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। পুলিশের ভূমিকা আরো সক্রিয় করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জনবল বাড়ানো হবে। গতকাল বুধবার সকালে সাভারের রাজালাখ এলাকায় হর্টিকালচার সেন্টারে কৃষকের মিনি কোল্ড স্টোরেজ কার্যক্রম ও ‘খামারি’ অ্যাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
এর আগে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ডেভিল হান্টের মতো একটা প্রচারসর্বস্ব তৎপরতা চলছে এবং এর মধ্যে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে, এটা মানুষকে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সদিচ্ছার ঘটতি নেই উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যে মন্ত্রণালয় সামলাতে পারছেন না এটা মোটামুটি পরিষ্কার। তার বক্তব্য বিবৃতিতে মানুষ আস্থা পাচ্ছে না। তিনি ও তার টিমের কাজ করার গতিটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তিনি যদি এটা উপলব্ধি করে সরে যান এবং তার জায়গায় দক্ষ কাউকে দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো ভালো হতে পারে।
সাইফুল হক বলেন, এর একটা রাজনৈতিক দিক আছে। আর সেটা হচ্ছে, মানুষ সরকারকে দুর্বল ও অকার্যকর মনে করছে। মানুষের মনে এ ধারণা জন্মাচ্ছে, সরকার কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। আর এটা যদি হয় তবে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে অভিযান চলছে, তার টার্গেট শুধু রাজনৈতিক ডেভিলদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা। এখন অপরাধীরা মনে করছেন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অভিযানের টার্গেট হলো শুধু রাজনৈতিক ডেভিলরা। আইনশৃঙ্খলার যারা অবনতি ঘটাচ্ছে বা চেষ্টা করছে তেমন সব ডেভিলকেই ধরতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ নিয়ে তিনি বলেন, পুলিশের একটি পেশাগত অন্তর্নিহিত শক্তি থাকে, যা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন বিতর্কিত হওয়ার ভয় কিংবা অন্য কোনো কারণে সেটি দৃশ্যমান নয় বলেই আইনশৃঙ্খলার ক্রমাগত অবনতি ঘটছে।
কেকে/এআর