জাতীয় নাগরিক পার্টি, এনসিপি আত্মপ্রকাশ সাড়া জাগিয়েছে দেশে। তবে দেশবিভাগের পর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ আর মুক্তিযুদ্ধের পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের সঙ্গে এটির ফারাক রয়েছে। ওই দুটি দলই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন চালিয়েছিল।
অন্যদিকে এনসিপি প্রথম থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের আশির্বাদ পেয়ে আসছে। আত্মপ্রকাশের দিনও লোক জড়ো করতে গাড়ি রিক্যুজিশনের অভিযোগ আছে, আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান নিয়েও আছে সমালোচনা। পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্ব নেন। অন্যদিকে সেক্টর কমান্ডার আব্দুল জলিল দায়িত্ব নেন জাসদের। এনসিপিতে একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ নেই, নেই স্বনামধন্য কোনো পেশাদারও। বিএনপি আত্মপ্রকাশের সময় সেখানে বিভিন্ন বাম সংগঠন ও ইসলামিক দলের নেতাদের যোগ দিতে দেখা গেছে। এমনটি হয়নি এনসিপির ক্ষেত্রে। আর শ্রমিক-কৃষকের কোনো প্রতিনিধিও জায়গা পাননি মূল দলের কমিটিতে।
গাড়ি নিয়ে সমালোচনার মুখে এনসিপি
রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে গত শুক্রবার ব্যাপক লোকসমাগম করে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন এ দলটি শুরুতেই সমালোচনার মুখে পড়েছে। আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সারাদেশ থেকে লোক জড়ো করতে সরকারিভাবে বাস রিক্যুইজিশনের ঘটনা কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এ সমালোচনা।
পিরোজপুর জেলা প্রশাসকের পক্ষে নেজারত ডেপুটি কালেক্টরের স্বাক্ষরে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পৃথক দুটি চিঠিতে আটটি গাড়ি প্রদান করা হয়। ওই চিঠিতে পিরোজপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা শাহনেওয়াজ অভিকে তিনটি এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে মুহাম্মাদ মুসাব্বির মাহমুদ সানিকে পাঁচটি গাড়ি বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
ওই চিঠিতে নেজারত ডেপুটি কালেক্টর উল্লেখ করেছেন, ‘অস্থাবর সম্পত্তি হুকুম দখল আইন অনুযায়ী সরকারি কাজে বা জনস্বার্থে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য সেবা অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি এক দিনের পিরোজপুর হতে ঢাকা গমনের জন্য পরিবহন বাস অধিযাচন করা হয়।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধি মুহাম্মদ মুসাব্বির মাহমুদ সানি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা শাহনেওয়াজ অভি ডিসির মাধ্যমে গাড়ি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, গাড়িগুলো তারা জেলা প্রশাসকের কাছে চেয়েছিলেন। তিনি গাড়িগুলোর রিক্যুইজিশন করে দিয়েছেন।
এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে কমপক্ষে ২৬টি জেলা থেকে গাড়ি রিক্যুইজিশনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পঞ্চগড় থেকে তিনটি এবং কুড়িগ্রাম থেকে পাঁচটি গাড়ি রিক্যুইজিশনের তথ্য নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত শনিবার বিকেলে গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সভাপতি নুরুল হক নুরু এ ঘটনার সমালোচনা করে বলেন, ‘নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে ঢাকায় এসেছে ছাত্র-জনতা, যা কাম্য নয়।’
নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য ঢাকার বাইরের জেলা থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতিনিধিদের জন্য কর্তৃত্ববাদের অনুকরণে সরকারিভাবে হুকুম-দখল করে পরিবহন বাস অধিযাচনের (রিক্যুইজিশন) ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে টিআইবি। একই সঙ্গে এনসিপির জন্মলগ্নেই এরূপ ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনৈতিকতার দায় অন্তর্বর্তী সরকার এড়াতে পারে না বলেও মন্তব্য করে বিবৃতি দিয়েছে সংস্থাটি।
অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ছাড়াই দল
দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যেমন অভিজ্ঞ মানুষ প্রয়োজন, তেমনি শীর্ষপদেও পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ দরকার। কিন্তু এনসিপির নেতৃত্বে নাহিদ ইসলাম একেবারেই আনাড়ি। গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে দিয়ে তিনি এ পদে এসেছেন। কিন্তু একটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া আর দল গঠন সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। ১৯৪৮ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সময় তার নেতৃত্বে ছিল মুসলিম লীগের সিনিয়র নেতারা। দলের সভাপতি হয়েছিলেন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তেমনি জাসদ গঠনের বেলায়ও বিচক্ষণ সেনা কর্মকর্তা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার আব্দুল জলিল হয়েছিলেন সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন সে সময়ে অভিজ্ঞ ছাত্রনেতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আ স ম রব। অথচ এনসিসির কমিটি স্থান পেয়েছেন তরুণরা, তাদের বড় অংশের গায়ে এখনো লেগে রয়েছে ছাত্রত্বের ঘ্রাণ।
কৃষক-শ্রমিক-পেশাদারদের কেউ নেই
একটি দল গঠনের বেলায় শ্রমিক ও কৃষকরা সবসময়ই গুরুত্ব পেয়ে আসছে। শ্রমিক ও কৃষক নেতারা গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে থাকেন। যে দেশ পোশাক শিল্পের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল, সেদেশে একটি দলের কমিটিতে স্থান পাননি কোনো শ্রমিক নেতা। অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি হলেও কোনো কৃষক নেতার জায়গা হয়নি নতুন দলের কমিটিতে। একজন চিকিৎসক জায়গা পেয়েছেন, কোনো প্রকৌশলীকৃষিবিদ, শিক্ষকের সেখানে স্থান হয়নি।
মধ্যপন্থি এত দলের ভিড়ে হারিয়ে যেতে পারে এনসিপি
দলটির দর্শন, ইশতেহার, সাংগঠনিক কাঠামো, গঠনতন্ত্র সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা পাওয়া যায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির মাঠে তাদের কর্মকাণ্ডই বলে দেবে কতটা টেকসই দল তারা হয়ে উঠবে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মত ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বা বামপন্থিদের মত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়নি জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারির নেতাদের নিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
ডান, বাম ও বিভিন্ন মত, ধর্ম ও পথের তরুণদের সামনে রেখে ভোটের রাজনীতিকে লক্ষ্য ধরে মাঠে নামা দলটি ‘ন্যায় ও সমতার’ ভিত্তিতে ‘বহুত্বপূর্ণ’ সমাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। তারা নতুন স্বাধীনতার কথাও বলেছে।
দেশে মধ্যপন্থি এত দল থাকতে একই লক্ষ্যে যাত্রা করা তরুণদের এই দলটি দেশের মানুষের কাছে কতটা আবেদন তৈরি করতে পারবে, সে প্রশ্নও রয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নিয়ে এখনই বিস্তারিত বলার সময় আসেনি। কারণ দলটির দর্শন, ইশতেহার, সাংগঠনিক কাঠামো, গঠনতন্ত্র সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা পাওয়া যায়নি।
এছাড়া রাজনীতির মাঠে বহু নতুন বিষয় আসবে, সেসব নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ডই বলে দেবে এনসিপি কতটা টেকসই দল হয়ে উঠবে। তবে সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে দলটি কয়েক বছরের মধ্যে শক্তি হারাতে পারে, হারিয়ে যেতে পারে আলোড়ন তোলা এনসিপি।
কেকে/এজে