উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ একজন বাঙালি সংগীতজ্ঞ। সেতার ও সানাই এবং রাগ সংগীতে বিখ্যাত ঘরানার গুরু হিসেবে সারা বিশ্বে তিনি প্রখ্যাত। মূলত সরোদই তার শাস্ত্রীয় সংগীতের বাহন হলেও সাক্সোফোন, বেহালা, ট্রাম্পেটসহ আরো অনেক বাদ্যযন্ত্রে তার যোগ্যতা ছিল অপরিসীম।
তিনি সাদাসিধে ও ভীষণ ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। আলাউদ্দিন খাঁ যন্ত্রসংগীতের ভুবনে এক আমূল পরিবর্তন আনেন। রবাব, বীণা, সুরশৃঙ্গার, সেতার আর সুরবাহার যন্ত্র বাজানোর আঙ্গিকে সরোদের রীতি প্রচলন করেন। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের শূন্যতা পূরণ করেন বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে আলাউদ্দিন খাঁ। সংগীতের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় তিনি শৈশবেই বাড়ি থেকে পালিয়ে নিরন্তর সাধনার সুদীর্ঘ যন্ত্রণাকাতর পথ বেয়ে বাংলার সীমা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেন সর্বভারতীয় এক গৌরব।
উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ একজন বাঙালি সংগীতজ্ঞ। বাবা আলাউদ্দিন খান নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। সেতার ও সানাই এবং রাগ সংগীতে বিখ্যাত ঘরানার গুরু হিসেবে সারা বিশ্বে তিনি প্রখ্যাত। মূলত সরোদই তার শাস্ত্রীয় সংগীতের বাহন হলেও সাক্সোফোন, বেহালা, ট্রাম্পেটসহ আরো অনেক বাদ্যযন্ত্রে তার যোগ্যতা ছিল অপরিসীম।
১৯১৮ সালের পর তিনি ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘খাঁ সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৫২ সালে ভারতের সংগীত আকাদেমি পুরস্কার পান। ১৯৫৪ সালে আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে ‘পদ্মভূষণ’ ও ১৯৭১ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ১৯৬১ সালে তিনি বিশ্বভারতী কর্তৃক দেশি ‘কোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন। ভারতের দিল্লি ও বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে আজীবন সদস্যপদ দান করেন। শান্তি নিকেতনে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে কিছুকাল অধ্যাপনা করেন।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাদাসিধে ও ভীষণ ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। নিয়মিত নামাজ পড়তেন। অর্থের প্রতি কোনো ধরনের লোভ ছিল না তার। অনেক বড় বড় দরবার থেকে (হায়দরাবাদ, কাশ্মীর) মোটা টাকার চাকরির আমন্ত্রণ পেয়েছেন। কিন্তু মাইহারের সামান্য টাকার চাকরি ছেড়ে সেসব জায়গায় যাননি তিনি। সুরের নেশায় ছোটবেলায় স্কুল পালিয়েছেন, বাড়ি ছেড়েছেন দুবার। সুরের টানে গেছেন কলকাতায়। কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের নাচের দলের সঙ্গে ভ্রমণ করেছেন ইউরোপে।
আলাউদ্দিন খাঁ বাঁশি, পিকলু সেতার ম্যাডোলিন ব্যাঞ্জু, সানাই, নাকাড়া, তবলা ও সরোদসহ আরো বিভিন্ন যন্ত্র বাজানো শেখেন। সংগীত জীবনে তিনি বড় ভাই ফকির আফতার উদ্দিন, ননো গোপাল, অমৃত লাল দত্ত, লবু সাহেব, অমর দাস, হাজারী ওস্তাদ, ওস্তাদ আহাম্মদ আলী খাঁ, তানসেন বংশীয় বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁসহ আরো অনেকের কাছে দীর্ঘ ৩০ বছর সংগীতের কলাকৌশল শেখেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সংগীত শেখেন তার ছেলে আলী আকবর খাঁ, মেয়ে অন্নপূর্ণা, মেয়ের জামাই রবি শঙ্করসহ আরো অনেক বিখ্যাত শিল্পীরা। বিশ্বখ্যাত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কোনোদিন কোনো ছাত্রকে শিখানোর বিনিময়ে তার কাছ থেকে টাকা পয়সা নিতেন না। এমনকি গ্রহণ করতেন না কোনে উপহার সামগ্রীও।
আলাউদ্দিন খাঁর কাছে পদ্ধতিগতভাবে শিক্ষা লাভ করতে শিষ্যদের কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। প্রতিদিন একটানা ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা রেওয়াজের ভেতর তাদের নিবদ্ধ থাকতে হতো। কারণ আলাউদ্দিন তাদের শুরুতেই মন্ত্র দিতেন, সাধনা ছাড়া সিদ্ধি লাভ হয় না।
প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায় শেষ হয়ে গেলে আলাউদ্দিন নিজের কণ্ঠে গাইতেন এবং যন্ত্রে বাজাতেন। শিষ্যরা তাকে অনুসরণ করত। এতে তিনি শিষ্যদের জ্ঞানের গভীরতা পরীক্ষা করতে পারতেন। ছোটখাটো ভুল-ভ্রান্তি হলে তিনি তা শুধরিয়ে দিতেন। তবে বড় ধরনের ভুল হলে বেশ রেগে যেতেন। তিরস্কার করতেন। কেননা তিনি ভীষণ কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন। ভুল হলে ভাবতেন শিষ্যের অমনোযোগের কারণেই ঘটেছে। আর অমনোযোগ ছিল তার নিকট ক্ষমাহীন অপরাধ। অমনোযোগী হওয়ার কোনো পথ ছিল না। স্বর এবং সুরের প্রতিটি খুঁটিনাটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি শিষ্যদের শেখাতেন।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ যন্ত্রসংগীতের ভুবনে এক আমূল পরিবর্তন আনেন। রবাব, বীণা, সুরশৃঙ্গার, সেতার আর সুরবাহার যন্ত্র বাজানোর আঙ্গিকে সরোদের রীতি প্রচলন করেন। তিনি শুদ্ধ ‘ডারা ডারা’ এবং ‘রাডা রাডা’ বাজাবার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সংগীতে এক অভূতপূর্ব বাজ প্রচলন করেন। একটি যন্ত্রের বাজানোর ঢঙ বিভিন্ন যন্ত্রে সংযোজন করার চিন্তা আলাউদ্দিনের আগে কোনো সংগীতজ্ঞ করেননি। তার এ আবিষ্কারে সংগীত ভুবনে এক আলোড়নের সৃষ্টি হয়।
আলাউদ্দিন তার গুরু ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে ধ্রুপদ আর ধামারের বিভিন্ন ঢঙের কলাকৌশল শিখেছিলেন। মধ্যযুগ এবং পরবর্তীকালের সংগীতজ্ঞরা সংগীতের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন; কিন্তু আলাউদ্দিন ছিলেন সংগীতের সর্বক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। তিনি সংগীত পরিবেশনের আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। তার উদ্ভাবিত নতুন আঙ্গিকের সংগীতকে দেশে এবং বিদেশে জনপ্রিয় করে তোলেন তার দুই শিষ্য পুত্র আলী আকবর খাঁ, জামাতা রবিশঙ্কর।
আলাউদ্দিন খাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নতুন ‘বাজ’ সৃষ্টিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি অনেকগুলো তাল সৃষ্টি করেন। তার সৃষ্ট তালগুলোর মধ্যে মোহন তাল (সাড়ে তিন মাত্রা), রাজবেশ তাল (সাড়ে চার মাত্রা), উদয়সিংহ তাল (সাড়ে পাঁচ মাত্রা), বিজয় তাল (সাড়ে ছয় মাত্রা), বিজয়ানন্দ তাল (সাড়ে সাত মাত্রা), উপরাল তাল (সাড়ে আট মাত্রা), বিক্রম তাল (সাড়ে নয় মাত্রা), লঘুকির তাল (সাড়ে দশ মাত্রা), রঙ তাল (সাড়ে এগারো মাত্রা), রঙবরণ তাল (সাড়ে বারো মাত্রা), রঙরায়াত তাল (সাড়ে তেরো মাত্রা), অভিনন্দন তাল (সাড়ে চৌদ্দ মাত্রা) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আলাউদ্দিন খাঁর প্রিয় রাগগুলো ছিল ইমন, হেমন্ত, হেম-বেহাগ, তিলকামেছ, শ্রী, বিলাবল, দরবারী, শুদ্ধ বসন্ত, পুরিয়া ধানেশ্রী, শুদ্ধ ভৈরবী এবং শুদ্ধ কল্যাণ।
ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের ইতিহাসে বহুদিন কোনো বাঙালির নাম ছিল না। এই শূন্যতা পূরণ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে আলাউদ্দিন খাঁ। সংগীতের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় তিনি শৈশবেই বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। তারপর নিরন্তর সাধনার সুদীর্ঘ যন্ত্রণাকাতর পথ বেয়ে তিনি বাংলার সীমা ছাড়িয়ে হয়ে উঠলেন সর্বভারতীয় এক গৌরব। মূলত সরোদ-বাদক হলেও ধ্রুপদী সংগীতের নানা ক্ষেত্রে এক অনুসরণীয় গুরু। তার হাতেই সৃষ্টি হয়েছে প্রসিদ্ধ মাইহার ঘরানা। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, ভারতীয় চিরায়ত সংগীতের সঙ্গে সম্পর্কিত সব ধরনের যন্ত্র তিনি কুশলতার সঙ্গে বাজাতে পারতেন। তার শিষ্যদের দিকে তাকালে, বাদ্যযন্ত্রের সমাহার যে দেখা যায়, তার বিচারে তাকে অতিমানবীয় গুণের অধিকারী বলে মনে হয়। তিনি তার পুত্র ওস্তাদআলী আকবর খানকে সরোদ, পণ্ডিত রবি শঙ্কর ও নিখিল বন্দোপাধ্যায়কে সেতার, কন্যা বিদুষী অন্নপূর্ণাকে সুরবাহার, পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ ও বিজনাথ ঘোষকে বাঁশি, পণ্ডিত রবীন ঘোষকে বেহালা শিখিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে এরা সবাই জগতবিখ্যাত হয়েছেন।
তিনি সমাজসেবামূলক কাজ সম্পাদন করেছেন। শিবপুর গ্রামে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন এবং পানীয় জলের সমস্যা দূর করতে একটি পুকুর খনন করিয়ে দিয়েছেন। তার নির্মিত মসজিদটি এখনও তার স্মৃতিবহন করে চলছে। তিনি বলতেন, সংগীত আমার জাতি আর সুর আমার গোত্র। মাইহার রাজ্যে, ‘মাইহার কলেজ অব মিউজিক’ প্রতিষ্ঠা তার সংগীত জীবনের এক শ্রেষ্ঠ অবদান। তিনি ছিলেন কলেজের সর্বেসর্বা পরিচালক।
জন্ম ও কৈশর
বিশ্বের সংগীত জগতে ‘সুর সম্রাট’ খ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁও ছিলেন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। মায়ের নাম সুন্দরী বেগম। শিশুকাল থেকেই সুরের প্রতি তার এক অন্যরকম আকর্ষণ ছিল। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এর বড় ভাই ফকির ‘তাপস’ আফতাব উদ্দিন খাঁর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি তার। সুরের সন্ধানে মাত্র ১০ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক যাত্রাদলে যোগ দিয়ে ঘুরে বেড়ান গ্রামে গ্রামে। ওই সময় তিনি জারি-সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, পাঁচালি প্রভৃতি গানের সঙ্গে পরিচিত হন। পরে কলকাতায় গিয়ে প্রখ্যাত সংগীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বাঁশি, পিকলু, সেতার, ম্যাডোলিন, বেঞ্জো ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন সংগীত পরিচালক অমৃত লাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের কাছে। সেই সঙ্গে তিনি লবো সাহেব নামে এক গোয়ানিজ ব্যান্ডমাস্টারের কাছে পাশ্চাত্য রীতিতে এবং বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ অমর দাসের কাছে দেশীয় পদ্ধতিতে বেহালা শেখেন। এছাড়া হাজারী ওস্তাদের কাছে শেখেন মৃদঙ্গ ও তবলা। এভাবে তিনি সর্ববাদ্যবিশারদ হয়ে ওঠেন।
পারিবারিক জীবন
যৌবনকালে আলাউদ্দিন খাঁ মেজ ভাইয়ের সঙ্গে দেশে আসেন। বাবা-মা মদিনা বিবি নাম্নী এক সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ের রাতেই তিনি ঘুমন্ত স্ত্রীকে রেখে পলায়ন করেন সংগীত সাধনার ডাকে। পরে তিনি মদিনা বিবিকে নিয়েই সংসার পেতেছিলেন মাইহার রাজ্যে। তার এক পুত্র তিন মেয়ে। পুত্রের নাম আলী আকবর খাঁ। তার কন্যা অন্নপূর্ণার স্বামী পণ্ডিত রবিশঙ্কর পরবর্তীতে পাশ্চাত্যে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ঘরানার সংগীত পরিবেশন করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন ।
দেড়শ বছর পর আলাউদ্দিন খাঁর মা-বাবার কবর সংরক্ষণ
প্রায় দেড়শ বছর আগে সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর বাবা-মা মৃত্যুবরণ করেন। তাদের শিবপুরে নিজ বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া হয়। বিগত দেড়শ বছর যাবত অরক্ষিত ও অবহেলায় ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বাবা-মায়ের কবর। অবশেষে দেড়শ বছর পর জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আলাউদ্দিন খাঁর বাবা-মায়ের কবর সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাদের কবরের সঙ্গে রয়েছে আলাউদ্দিন খাঁর এক বোনের কবরও। তাদের মৃত্যুর প্রায় দেড়শ বছর পর কবরটি সংস্কার করে দৃষ্টিনন্দনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। তার নামে গড়ে উঠেছে শিবপুর ওস্তাদ আলাউদ্দি খাঁ কলেজ। সেই কলেজে তার ইতিহাস সম্বলিত ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ নিজ অর্থে একটি পুকুর খনন করে এক পাড়ে একটি মসজিদ তৈরি করে গিয়েছিলেন। মসজিদটিও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংস্কার করা হয়েছে।
যোগ্য শিষ্য তৈরি
বহুসংখ্যক যোগ্য শিষ্য তৈরি তার অপর কীর্তি। আলাউদ্দিন খাঁর ছেলে আলী আকবর খাঁ বা মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবী ছাড়াও তার ভাগ্নে রাজা হোসেন খান এবং নাতি আশীষ খানও সংগীতজ্ঞ হয়েছেন। তার অন্যান্য সফল শিষ্যদের মধ্যে রয়েছেন- তিমির বরণ, জামাতা পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর হোসেন খান, ফুলঝুরি খান, খাদেম হোসেন খান, মীর কাশেম খান, পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য, পান্নালাল ঘোষ, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, পৌত্র আশীষ খান, ধ্যানেশ খান, খুরশীদ খান, ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য, ডেভিড পোদিআপ্পুহামি এবং ডব্লিউ.ডি. অমরদেব প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবন
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পরামর্শ ও নির্দেশে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়। সেগুলির মধ্যে ‘চন্দ্রসারং’ ও ‘সুরশৃঙ্গার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক রাগ-রাগিণীও সৃষ্টি করেন, যেমনÑ হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, মেঘবাহার, প্রভাতকেলী, হেম-বেহাগ, মদন-মঞ্জরী, মোহাম্মদ (আরাধনা), মান্ঝ খাম্বাজ, ধবলশ্রী, সরস্বতী, ধনকোশ, শোভাবতী, রাজেশ্রী, চন্ডিকা, দীপিকা, মলয়া, কেদার মান্ঝ, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি। তিনি স্বরলিপিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার বহুগানের স্বরলিপি সংগীতবিজ্ঞান প্রবেশিকা গ্রন্থে নিয়মিত প্রকাশ হতো।
সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন
১৯৫৬ সালে আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাস করার ইচ্ছায় শহরের পুরাতন জেল রোডের বাড়িটি আলাউদ্দিন খাঁ কিনে নেন। সেই বাড়িই এখন ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন’, যেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি জাদুঘর’। ১৯৭৩ সালে বাড়িটিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই সংগীত অ্যাকাডেমি ও জাদুঘর। ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান এটি উদ্বোধন করেন। এই সংগীতাঙ্গনে কণ্ঠ, যন্ত্রসংগীত, চিত্রাঙ্কন ও নৃত্যকলা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে এখানে চার শ শিক্ষার্থী আছে। এ মিলনায়তন শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নিজেদের অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জাদুঘরে আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত দুটি সরোদ, দুটি বেহালা, একটি সন্তুর, একটি ব্যাঞ্জো ও একটি সারেঙ্গি, তার হাতে লেখা অন্তত ২৫টি চিঠি, হজের সময় সৌদি আরবের বাদশাহর দেওয়া জায়নামাজ, ব্রিটিশ শাসনাধীন তৎকালীন ভারতের দেশীয় রাজ্য মাইহারের রাজা বৃজনাথ সিংয়ের দেওয়া রেওয়াজের দুটি গালিচা, তার নিজের একটি বড় ছবি এবং দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনায়ক, সরকারপ্রধান ও বিশ্ব ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তোলা অন্তত এক হাজার দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র ও আলোকচিত্রের অনুলিপি ছিল। দুই দফা আগুনের গ্রাসে প্রায় সবই গেছে।
মাইহার কলেজ অব মিউজিক
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন এক সংস্কৃতিসেবক মহারাজার সভাসংগীতজ্ঞ ও রাজ-গুরু। আলাউদ্দিন খাঁ মাইহারের একটি সংগীত কলেজ প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। মহারাজার কাছে তার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি তাকে উৎসাহিত করেন। আলাউদ্দিন প্রচুর পরিশ্রম করে মাইহারে একটি মিউজিক কলেজ স্থাপন করেন। এ কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পৃষ্ঠপোষকতা করেন মাইহারের মহারাজা এবং বিন্ধ্য প্রদেশ সরকার। কলেজের নাম রাখেন ‘মাইহার কলেজ অব মিউজিক’।
কয়েকটি অতিথিশালায় প্রথম এ কলেজের সংগীত শিক্ষার কাজ শুরু হয়। হোস্টেলের ব্যবস্থাও ছিল। দূরদূরান্ত থেকে আগত সংগীত শিক্ষার্থীরা সেখানে থাকতেন। কলেজের জন্য পরে দালান তৈরি করা হয়। সংগীত শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে শিক্ষা দেওয়া হতো। কলেজে পাঁচ বছর মেয়াদি কোর্স চালু ছিল। পাঁচ বছর শিক্ষা লাভের পর শিক্ষার্থীদের ‘ব্যাচেলর অব মিউজিক’ সনদ প্রদান করা হতো। আলাউদ্দিন খাঁর প্রচেষ্টায় কলেজটি মধ্য প্রদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে। কলেজের প্রতি বিভাগের জন্য অভিজ্ঞ সংগীতজ্ঞ রাখা হতো। আর আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন কলেজের সর্বেসর্বা পরিচালক।
মাইহার স্ট্রিং ব্যান্ড
আলাউদ্দিন খাঁ ‘মাইহার স্ট্রিং ব্যান্ড’ সৃষ্টি করেন। মধ্য প্রদেশের সাতনা জেলার একটি অপরিচিত করদ রাজ্য মাইহার। জনকোলাহল থেকে বহু দূরে একটা পাহাড়িয়া শহর মাইহার। মহারাজ বৃজ নারায়ণ সিংহ এ রাজ্যের শাসনকর্তা। সংগীতে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তার গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। আলাউদ্দিন খাঁ ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র সমন্বয়ে তৈরি করলেন একটি বৃন্দবাদ্যের দল। নাম রাখেন ‘মাইহার স্ট্রিং ব্যান্ড’। প্রায় ৪০ জন শিল্পী এ দলে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। তাদের সবাই আপন আপন বাদ্যযন্ত্র বাদনে পারদর্শী ছিলেন। সবাই পৃথকভাবে আলাউদ্দিন খাঁর কাছে শিখতেন। ভারতীয় যন্ত্রসংগীতে আলাউদ্দিন প্রথম বৃন্দবাদনের প্রবর্তন করেন।
সপ্তাহের প্রতিদিন বাদ্যযন্ত্রীদের রেওয়াজ আর অনুশীলন চলত। কোনো কথাবার্তা নেই। নীরবে যার যার যন্ত্র রেওয়াজে নিমগ্ন থাকতেন। ফলে সমবেতভাবে যখন তারা ঐকতান পরিবেশন করতেন তখন সুরের অনুরণনে পরিবেশ উঠত ভরে। ঐকতান শুরু হতো ‘তিলকামোদ’ রাগ দিয়ে। তারপর ‘ভৈরবী’ রাগের সংমিশ্রণে গৎ পরিবেশিত হতো। আলাউদ্দিন খাঁ ঐকতান রচনা করতেন। এ বৃন্দবাদনে হারমোনিয়াম, তবলা, সেতার, সরোদ, এসরাজ, বেহালা, নল তরঙ্গ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হতো। ১৯২৫ সালে লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে সর্বপ্রথম জনসাধারণ্যে ঐকতান বাজিয়ে মাইহার স্ট্রিং ব্যান্ড প্রভুত সুনাম অর্জন করে। আলাউদ্দিন খাঁ স্বয়ং এ ঐকতান পরিচালনা করেন। এ বৃন্দবাদন প্রবর্তনের ফলে সংগীতের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানি মাইহার স্ট্রিং ব্যান্ডের ঐকতান রেকর্ড বের করে।
চলচ্চিত্র
উস্তাদ আলাউদ্দীন খান (১৯৬৩), ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র। বাবা আলাউদ্দীন খান (১৯৬৫), হরিসাধন দাসগুপ্ত পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র। রাগা (১৯৭১), হাওয়ার্ড ওয়ার্থ পরিচালিত। ইস্ট মিটস ওয়েস্ট মিউজিক কর্তৃক ২০১০-এ রিমাস্টার করা সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মৈহার রাগ (১৯৯৩), সুনীল শানবাগ পরিচালিত। মাইহারে আলাউদ্দিন খানের বিধ্বস্ত ঐতিহ্যের দিকে এক নজর, ১৯৯৪ সালে ঘধঃরড়হধষ ঋরষস অধিৎফ ভড়ৎ ইবংঃ ঘড়হ-ঋবধঃঁৎব ঋরষস পুরস্কার পান।
প্রয়াণ
রাগসংগীতকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া এই সংগীতজ্ঞ ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের মাইহারে মৃত্যুবরণ করেন। পরে সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।
কেকে/এজে