মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার হিসেবে পরিচিত শিহাব হোসেন শয়ন ওরফে আরাফাতকে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সোমবার (৪ মার্চ) মধ্যরাতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। এ সময় তার দুই সহযোগী হৃদয় ও সোহাগকেও গ্রেফতার করা হয়, তবে তার অন্যতম সহযোগী এবিএম মাহমুদুল বশ্রী ওরফে জন এবং মিটু পালিয়ে যায়।
শিহাব হোসেন শয়ন দীর্ঘদিন ধরে মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা এই গ্যাংয়ের মূল কাজ ছিল ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক কারবারি, জমি-ফ্ল্যাট দখল ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। শয়ন তার গ্যাং পরিচালনায় হৃদয়, সোহাগ, মিটু ও বশ্রী জনকে সঙ্গে রাখত।
জানা গেছে, কয়েকজন দিনে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করত, আর রাতে ছিনতাই ও প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিত। মিটুর বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় একাধিক মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ছাত্র হত্যার অভিযোগও রয়েছে। শয়ন ছিল পুরো চক্রের মূল হোতা, যার নেতৃত্বে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান জানান, শয়নকে আদাবর থানার এক মামলায় আদালতে হাজির করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মামলাতেও তাকে গ্রেফতার দেখানো হবে।
যৌথ বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, শয়ন মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের অন্যতম সহযোগী। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২৮ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফোরকান ও রাষ্ট্রনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সরকারের পতনের পর সে শেরপুরে পালিয়ে যায়, তবে সম্প্রতি সে ঢাকায় ফিরে এসে আগারগাঁওয়ে তার গ্যাং পুনর্গঠনের চেষ্টা করছিল। সংবাদের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে এবং শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শয়ন মিরপুর মডেল থানাধীন ১৩ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ছিল। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ ১৫টিরও বেশি ফৌজদারি মামলা রয়েছে।
শয়নের নিয়ন্ত্রণে ছিল মোহাম্মদপুর, আদাবর, আমতলা, বটতলা ভাঙা ব্রিজ, লেকভিউ সোসাইটি, ওসমান গনি রোড, ছয়তলা গার্মেন্টসসহ একাধিক এলাকা। এসব এলাকায় মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, জমি-ফ্ল্যাট দখল, যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি এবং প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভয় দেখিয়ে মোবাইল ও টাকা ছিনতাই করা ছিল তার গ্যাংয়ের নিত্যদিনের কাজ।
শয়নের অন্যতম সহযোগী জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সে অসাধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মিলে টাকা নিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর কাজ করত। বিভিন্ন ব্যক্তিকে অস্ত্র ও নারী সংক্রান্ত মামলায় ফাঁসিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে জন ও শয়নের বিরুদ্ধে।
বিগত সরকারের সময় শয়ন ও তার চক্র টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফোরকান, তার ভাই আসাদ এবং ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নুর ইসলাম রাষ্ট্রনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তারা শয়নকে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া দিয়েছিল, ফলে সে নির্বিঘ্নে তার অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারত।
সরকার পরিবর্তনের পর শয়ন ও তার সহযোগীরা কিছুদিন আত্মগোপনে ছিল। তবে সম্প্রতি তারা আবারো সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করলে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে। সেনাবাহিনীর এই গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে শয়নকে গ্রেফতার করা হয়, যা এলাকাবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, প্রশাসনের তৎপরতায় এখন কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং অপরাধ কমবে।
কেকে/এএম