সারা দেশে ডাকাতির ঘটনা বেড়েই চলেছে। দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কেও ঘটছে ডাকাতি ও ছিনতাই। শুধু রাতেই নয়, দিনে-দুপুরে সড়কে যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে, গাছ ফেলে হানা দিচ্ছে ডাকাতরা। যাত্রীদের মারধর করে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। কোনো কোনো অঞ্চলে পাহারাদারকে খুন করে লুটপাটের ঘটনাও ঘটছে।
সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় পরিবহনের যাত্রীসহ সাধারণ মানুষে মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ডাকাতির কারণে আসন্ন ঈদে পরিবহন খাতে অর্ধেক বাজার হারানোর আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। ফলে সড়ক-মহাসড়কে নিরাপত্তায় প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও ঢিলেঢালা টহল ব্যবস্থার কারণেই ডাকাতি বাড়ছে বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। ডাকাত-আতঙ্কে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ক্রমেই দূরপাল্লার যাত্রীও কমছে বলে দাবি করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
হাইওয়ে পুলিশ বলছে, নানা সীমাবদ্ধতা থাকার পরও মহাসড়কে নিরাপত্তা বাড়াতে এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগসহ জনবল বাড়ানো হয়েছে। সেইসঙ্গে হাইওয়ে থানার পাশাপাশি জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে সড়কগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় মাসে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় ১৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র সব সময় বোঝা যায় না। গণঅভ্যুথানের ছয় মাস পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি না হওয়ায় মানুষের মনে নিরাপত্তা প্রশ্নে ভয়ের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, জনগণ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেলে সমস্যা, বাহিনী দিয়ে কন্ট্রোল করা যায় না। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনে ট্যুরিস্ট পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। সম্প্রতি গুলশানের এক বাসায় তল্লাশির নামে তছনছ, ভাঙচুর এবং লুটপাট চালানো হয়। এর আগে সোমবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় মসজিদের মাইকে ডাকাত এসেছে ঘোষণার পর পিটুনিতে দুজন নিহত হন।
দুর্গাপুরে পাহারাদারকে খুন করে ৭ গরু লুট : নেত্রকোণার দুর্গাপুরে একটি গরুর খামারের পাহারাদারকে হত্যা করে ৭টি গরু লুট করেছে ডাকাত দল। শ্যামগঞ্জ-দুর্গাপুর সীমান্ত সড়কে দুর্গাপুরের কাকৈরগড়া ইউনিয়নের গোদারিয়া চৌরাস্তা এলাকায় মাহবুবুল হকের খামারে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোররাতে এই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় খামারের ৬৫ বছর বয়সি পাহারাদার, জয়নাল মিয়াকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, তার হাত-মুখ বেঁধে, পিলারের সঙ্গে বেঁধে রেখে পালিয়ে যায় ডাকাত দল। খামারে থাকা মোট ১১টি গরুর মধ্যে ৭টি গরুই নিয়ে গেছে তারা। সকালে স্থানীয়রা এসে জয়নাল মিয়াকে পিলারের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন এবং পুলিশকে খবর দেন।
পুলিশ সুপার মির্জা সায়েম মাহমুদ পাহারাদার হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘পাহারাদার জয়নাল মিয়াকে হত্যা করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তবে ঘটনাটির পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
রাতে বাসে ডাকাত আতঙ্ক, কমছে যাত্রী : ইদানীং রাতে বাসে ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে। যাত্রীবেশে বাসে উঠে চালক, সহকারী ও সুপারভাইজারসহ যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব ছিনতাই করে নিচ্ছে ডাকাতদল। এ অবস্থায় রংপুরসহ আশপাশের জেলা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেটসহ রাতে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসে যাত্রী কমছে। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাসমালিকরা। তারা বলছেন, ডাকাতদলের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় জড়িত। কেউ গার্মেন্টসে খণ্ডকালীন কাজ করেন। আবার কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন বা অটোরিকশা চালান। এরাই রাতের বেলা হয়ে ওঠে ভয়ংকর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাসমালিক বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, মদনপুর, কাঁচপুর, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঘোড়াশাল টোলপ্লাজা থেকে ইটাখোলা মোড় এবং রংপুর-ঢাকা রুটে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। এদের নিয়মিত মাসোহারা দিতে হয়। কোনো কারণে একটু কমবেশি হলেই তারা হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করেন। নয়তো রাতে বাস থামিয়ে মালামাল লুট করে নিয়ে যান।
সম্প্রতি বাস ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় যাত্রী সংখ্যা কমছে দাবি করে ওই বাসমালিক বলেন, গত পরশু রাতে ১৩ জন যাত্রী নিয়ে নীলফামারী থেকে সিলেট গেছে তার বাস। আর গতকাল রাতে এসেছে ১৪ জন যাত্রী নিয়ে। আগের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ যাত্রীও মিলছে না।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, গত দেড় মাসে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় ১৬টি মামলা হয়েছে। তবে সড়কে ডাকাতির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। ডাকাত আতঙ্কে রাতে দূরপাল্লার বাসের যাত্রী কমেছে। এ পরিস্থিতির জন্য যাত্রী ও সংশ্লিষ্টরা দায়ী করছেন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, টহল না থাকা ও ঢিলেঢালা নিরাপত্তাকে।
চট্টগ্রাম থেকে রংপুর আসার পথে কয়েকদিন আগে কালিয়াকৈর ব্রিজের কাছে ডাকাতির কবলে পড়ে মাসুদ পরিবহনের একটি বাস। ওই বাসের সুপারভাইজার সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘চান্দুরায় চারজন যাত্রীবেশে উঠেছিল। কালিয়াকৈর ব্রিজের কাছে এসে সামনে একটি প্রাইভেটকার গতিরোধ করে। এরপর যাত্রী বেশে থাকা ডাকাতদলের সদস্যরা টাকা ও বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এসময় ডাকাত সদস্যরা তাকে বেধড়ক মারধর করে। হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এক সপ্তাহ।’
রংপুর-চট্টগ্রাম রুটের বাসমালিক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় আমরা বাসমালিকরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাস বন্ধ করে দিতে হবে।’
সড়কে গাছ ফেলে মধ্যরাতে গণডাকাতি : মধ্যরাতে সড়কে গাছ ফেলে বাস-ট্রাকসহ বেশ কয়েকটি গাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনগত রাত দেড়টার দিকে পাবনা-সাঁথিয়া সড়কের ছেচানিয়া ব্রিজের পাশে ঘটে এ ঘটনা।
দাউদকান্দিতে প্রবাসীর বাড়িতে ডাকাতি : গত তিন দিনে মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও সদর দক্ষিণ থানার নাকের ডগায় একই কায়দায় তিনটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। গত বুধবার দিবাগত রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার জিংলাতলী গ্রামের পশ্চিম পাড়ার এক প্রবাসীর বাড়িতে ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে। এ সময় ডাকাতরা নগদ ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা তিন হাজার ডুবাই দেরহামসহ প্রায় দশ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে গৌরীপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে এস আই সাইদুল ঘটনার স্থান পরিদর্শন করেন।
সাভারে বাসে ডাকাতি, কারখানায় লুট : গত রোববার দুপুরে সাভারের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ব্যাংক টাউন এলাকায় অস্ত্রধারী ডাকাতরা যাত্রীদের জিম্মি করে মোবাইল, মানিব্যাগ, স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়।
এদিকে গত ১ মার্চ ভোরে ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার ম্যাগপাই কম্পোজিট লিমিটেড কারখানায় নিরাপত্তা কর্মীদের মারধর করে নগদ অর্থসহ ইলেক্ট্রিকসামগ্রী লুট করেছে ডাকাতদল। এ সময় পাশের একটি বিকাশ এজেন্টের দোকানেও ডাকাতি করে তারা। এ ঘটনায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে শিল্প পুলিশ।
আশুলিয়া থানার এসআই আনোয়ার হোসেন বলেন, ঘটনাস্থলে শিল্প পুলিশ, থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি টিম উপস্থিত হয়েছেন। কি পরিমাণ মালামাল লুট হয়েছে তার তালিকা করা হচ্ছে।
তরুণীকে ছুরিকাঘাত করে ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাই : টাঙ্গাইলের সখীপুরে রুমা আক্তার (৩০) নামে তরুণীকে ছুরিকাঘাত করে ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সখীপুর-কচুয়া সড়কের পৌর শহরের মা ও শিশু কেয়ার ক্লিনিকের সামনে এ ঘটনা ঘটে। সখীপুর থানার ওসি মো. জাকির হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, রুমা তার তিন বছরের সন্তানকে নিয়ে ভ্যানে চড়ে পৌর শহর থেকে বাসায় ফিরছিলেন। পথে মিলপাড়ে মা ও শিশু কেয়ার ক্লিনিকের কাছে পেছন থেকে মোটরসাইকেলে আসা দুই যুবক তার ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দেয়। এতে সন্তানসহ রুমা রাস্তায় পড়ে যান। তখন রুমার গালে ছুরিকাঘাত করে ব্যাগটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
কেকে/এআর