ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট পতন ঘটে হাসিনা সরকারের। আর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অভ্যুত্থানের ছয় মাস যেতেই নানা বিতর্কে জাড়িয়ে পড়েছে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়ার ছাত্রদের এ সংগঠনটি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে বেড়ে চলছে নানা অপহরণ, চাঁদাবাজির মতো নানা অপরাধ। এসব ঘটনায় ব্যবস্থা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক সময় দ্বিধাগ্রস্ত দেখা গেছে। যা নতুন শঙ্কার সৃষ্টি করছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী পরিচয়ে এক বাড়িতে ঢুকে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর কলাবাগানে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-লুটের অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৪ নেতাকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। সারা দেশে এরকম অসংখ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রে নতুন উদ্বেগ তৈরি করছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের নামে আসলে পুরোনো দুর্বৃত্তায়নই ফিরে আসছে। এ বিষয়ে ছাত্র নেতৃত্বকে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে এবং এসব ঘটনা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও আরো তৎপর হতে হবে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী অথবা সমন্বয়ক পরিচয়ের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। গত শুক্রবার তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর আগের জায়গা নেই। সেখান থেকে একটি ছাত্র সংগঠন তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয়টা এখন আর এক্সিস্ট (অস্তিত্ব) করে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, এ পরিচয়ে ব্যবহার করে কেউ যদি অপকর্ম করে তাহলে তারা যেন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন।
নাহিদ ইসলাম বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয়ের অস্তিত্ব নেই বললেও ভিন্ন কথা বলছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মটি বিলুপ্ত করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশীদার ছাত্রদের সবাই নতুন রাজনৈতিক দল বা নতুন ছাত্র সংগঠনে যুক্ত হয়নি। অংশীদারদের আলোচনা ছাড়া প্ল্যাটফর্ম বিলুপ্ত হবে না। তাই বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ রইল।
এদিকে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া আহ্বান জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গতকাল বেলা সাড়ে ৩টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
গত শুক্রবার রাজধানীর কলাবাগানে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-লুটের অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৪ নেতাকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। তাদের কলাবাগান থানায় হস্তান্তর করা হয়। কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুক্তারুজ্জামান জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কলাবাগান থানার আহ্বায়ক সালাউদ্দিন সালমানসহ বিভিন্ন পদের ১৪ জনকে আটক করা হয়।
ওসি মুক্তারুজ্জামান বলেন, অভিযুক্তরা শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর রাসেল স্কয়ারে শেখ কবির নামের এক ব্যক্তির ব্যবসায়িক অফিসে হামলা চালায়। এ সময় ৩ লাখ টাকা, চারটি কম্পিউটার লুটসহ অফিসে হামলা ভাঙচুর চালানো হয়। আটকদের কাছ থেকে ৩১ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
হামলা-লুটের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার ১৪ জনের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কলাবাগান থানার আহ্বায়ক সালাউদ্দিন সালমানসহ সাতজনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। অপর সাতজন শিশু হওয়ায় আদালত তাদের গাজীপুরের টঙ্গীতে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। কারাগারে যাওয়া অপর ছয় আসামি হলেন সাইফুর রহমান রিয়েল খান (২১), সাজিদুল ইসলাম তাহমিদ (২০), শাহাদাত হোসেন (২০), মীর ফাহাদ আহমেদ উৎস (২৫), ছাব্বির আহম্মেদ আবির (১৯) এবং ফারহান (২৫)। অপর সাত শিশু আসামিকে গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি পরিচয়ে চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা ও তার গাড়িচালককে বাসা থেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে চারজনকে আটক করা হয়।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার রাতে নগরের আকবর শাহ থানার প্রভাতী স্কুলের বিপরীতে অবস্থিত বাসা থেকে আবেদীন আল মামুন ও তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক মো. জুয়েলকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আবেদীন আল মামুনের স্ত্রী ফাতেমা আক্তারের কাছে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন অপহরণকারীরা। ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ নগদে আদায় করা হয়, বাকি ১৫ লাখ টাকার চেক লিখে নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে অপহরণের খবর ছড়িয়ে পড়লে নগর পুলিশ পুরো শহরে তল্লাশি অভিযান শুরু করে। একপর্যায়ে ফয়’স লেক চক্ষু হাসপাতালের সামনে আবেদীন আল মামুন ও তার গাড়িচালককে রেখে চলে যান অপহরণকারীরা। এর আগে নগরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, পাহাড়তলী কর্নেল হাট ও আকবর শাহ এলাকায় অপহৃতদের ঘোরানো হয়।
আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান বলেন, বাসায় ঢুকে আবেদীন আল মামুনকে তার গাড়িচালকসহ অপহরণ করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ অপহৃত দুজনকে চক্ষু হাসপাতালের সামনের রাস্তা থেকে উদ্ধার করেছে। পরে নগরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে আটক করা হয়। তারা কেউ শিক্ষার্থী, আর কেউ পড়ালেখা শেষ করেছেন। আটক ব্যক্তিরা নিজেদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি দাবি করেছেন।
সংঘর্ষে জড়াল বৈষম্যবিরোধী ও নাগরিক পার্টির নেতা-কর্মীরা : পিরোজপুর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় উভয় পক্ষের অন্তত চারজন আহত হন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রতিনিধি মুসাব্বির অভিযোগ করেন, রাতের নামাজ পড়ে ভাইকে নিয়ে পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে গেলে আগে থেকে সেখানে থাকা বৈষম্যবিরোধী নেতা মুঈন লোকজন নিয়ে তাদের ওপর হামলা করেন। তিনি আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। হামলার ফলে তার পিঠ ও হাত এবং তার ভাই সানজিদ গলা ও পায়ে আঘাত পান।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা মুঈন উদ্দিন বলেন, সাধারণত আমরা তারাবিহর নামাজ শেষে পুরান বাসস্ট্যান্ডে চা খেতে আসি। হঠাৎ কোথা থেকে মুসাব্বির এসে শাহনেওয়াজকে বাজে কথা বলে এবং উচ্চবাচ্য করে। একসময় ওরা আমাদের ওপর হামলা করে।
গুলশানের মব তৈরি করে একটি বাড়িতে লুটপাট : ‘আওয়ামী লীগের দোসর লুকিয়ে আছে’- এমন গুজব ছড়িয়ে ‘মব’ সৃষ্টি করে রাজধানীর গুলশানের একটি বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত মঙ্গলবার রাত ১২টায় তল্লাশির কথা বলে বাড়িটিতে ঢুকে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট ও ভাঙচুর করে তারা। ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাস্থলে যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। প্রথমে কোনো ব্যবস্থা না নিলেও পরে ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে আটক করে গুলশান থানার পুলিশ। গত বুধবার বাসাটির নিরাপত্তাকর্মী আবদুল মান্নানের করা মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। জানা গেছে, ভাঙচুর হওয়া ওই বাড়িটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা প্রয়াত এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর।
কেকে/এজে