উত্তর সিটি কর্পোরেশন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে উন্নত মাঠ তৈরি করে দিয়েছেন নাগরিক সুবিধার জন্য এবং সেখানে ছেলে-মেয়ে এবং বয়স্কদের বিকালে একটু হাঁটাহাঁটি করার জন্য। কিশোর বয়সীদের খেলাধুলা করার জন্য মাঠগুলোকে সৌন্দর্য বর্ধন করেন সিটি কর্পোরেশন, কিন্তু সেই মাঠগুলোতে দিনে কিংবা সন্ধ্যা হলেই সেখানে মাদক বিক্রি হচ্ছে দেদারসে।
স্থানীয়রা জানান, মোহাম্মদপুর আলোচিত উর্দুভাষী জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ীরা ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন মাঠে। সন্ধ্যা হলে এখন আর মাঠে হাঁটা যায় না গাঁজার গন্ধে, প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে মাদক। এরমধ্যে রয়েছে, গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা।
খেলার মাঠে মাদক বিক্রির এমন তথ্য আসে খোলা কাগজের হাতে। তথ্য নিশ্চিত হওয়ার জন্য সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় , সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠের ভেতরে এক ধরনের লোক প্রবেশ করে, যাদের ভাষা বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এরা উর্দুভাষী ক্যাম্পের বাসিন্দা। একসময় ক্যাম্পের ভেতর মাদক বিক্রি করত। এখন ক্যাম্পের বাইরেও বিক্রি করছে মাদক, ছড়িয়ে দিচ্ছে গোটা মোহাম্মদপুর এলাকায়।
অনেকে বলছে, পুলিশের উপস্থিতি কম থাকায় তারা এই মাঠগুলো নিরাপদ ভেবে মাদক বিক্রি করে যাচ্ছে বিভিন্নভাবে।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে নিয়ন্ত্রণহীন মাদক অভিযান ও ক্যাম্পের বাইরে সিটি কর্পোরেশনের মাঠগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে মাদক। প্রতিটি মাঠে ৪-৫ জনের একেকটি গ্রুপ মাদক বিক্রি করে থাকে।
মাদক বিক্রির নিরাপদ স্থান হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ৭টি মাঠ। এগুলো হলো—শ্যামলী পার্ক, চাঁদের হাট মাঠ, বিজলি মহল্লা মাঠ, হুমায়ুন রোড মাঠ, শেরশাহ সুরি মাঠ, কিশলয় স্কুলের সামনে তাজমহল রোড মাঠ, আড়ং সংলগ্ন লালমাটিয়া স্টাফ কোয়াটার মাঠ।
জেনেভা ক্যাম্প এবং এই ৭টি মাঠ রয়েছে উত্তর সিটির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে। এই ওয়ার্ডটি যেই কাউন্সিলরের অধীনে থাকে, তার নিয়ন্ত্রণে থাকে জেনেভা ক্যাম্পটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এসব এলাকা। একেক নেতা একেকটি এরিয়া দেখভাল করে থাকেন। ৪টি এরিয়াতে রয়েছেন ৪ জন নেতা। অনেকেই এসব নেতাদের নাম বলতে চান না।
সন্ধ্যা হলেই শ্যামলী পার্কে মাদক বিক্রি করে মাদক ব্যবসায়ীরা। খিলজি রোড, বাবর রোড, জহুরী মহল্লার এক অংশ নিয়ে এই মাঠটি। এই মাঠের আশেপাশে প্রচুর আবাসিক ভবন রয়েছে এবং মাঠের পাশেই রয়েছে আশা ইউনিভার্সিটি।
মাদক বিক্রি হচ্ছে শ্যামলী ক্লাব মাঠের গলিতেও। শ্যামলী ক্লাব মাঠের সামনে রিং রোডে রয়েছে হলিউড নামে একটি মদের বার। এর আশেপাশে বিক্রি হচ্ছে গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা। এ এলাকাটির এক অংশ রয়েছে আদাবর থানা এরিয়াতে।
জহুরী মহল্লায় চাঁদের হাট মাঠেও বিক্রি হচ্ছে মাদক। বিজলি মহল্লায় মাঠেও বিক্রি করে মাদক। সেখানে স্থানীয় এক নেতার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, মাঠ এবং মাদক।
কয়েকজন বাসিন্দা জানান, এসব বিষয়ে কার কাছে অভিযোগ করব, পুলিশ তো দেখেই না। নতুন নতুন নেতারা এগুলো প্রশ্রায় দিচ্ছে। টাকার জন্য সমাজটাকে অনেকেই আপন ভাবে না। নতুন প্রজন্ম নিয়ে কারো চিন্তা নেই, আমাদের কষ্ট হচ্ছে।
জেনেভা ক্যাম্পের সংলগ্ন হুমায়ুন রোড মাঠেও সন্ধ্যা হলে বিক্রি হয় মাদক। সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, মাদক বিক্রির কেনাবেচা হচ্ছে। আবার অনেকেই সেখানে বসেই মাদক সেবণ করছে।
শেরশাহ সুরি রোড কবরস্থান মাঠেও দেখা যায় মাদক বিক্রিতাদের। সেখানে গোপনে বিক্রি হচ্ছে মাদক।
তাজমহল রোড কিশলয় স্কুলের সামনের মাঠটিতে দিনের বেলায় ঢুকলেও মাদকের গন্ধে হাঁটা যায় না। মাঠের সামনেই মোহাম্মদপুর এলাকায় ঐতিহ্য একটি স্কুল রয়েছে (কিশলয় স্কুল) অথচ সেই স্কুলের মাঠে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে গাজা ইয়াবা ও হেরোইনের মতো মাদক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মার্কেট ক্যাম্প এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা এই মাঠটিকে নিরাপদ স্থান মনে করে। সন্ধ্যা হলেই সেখানে বিক্রি করছে মাদক। এই মাঠটির সংলগ্ন রয়েছে জা্মিয়া বাইতুল আমান মিনার ইসলামি কেন্দ্র মসজিদ ও মাদ্রাসা।
সেখানকার কয়েকজন মুসুল্লি ও মাদ্রাসার কর্মকর্তা খোলা কাগজকে বলেন, গত ৫ আগস্টের আগেও এখানে মাদক সেবন এবং বিক্রি করত, কিন্তু এখন পুলিশের নজরদারি কম থাকায় আগের থেকে বেশি। এদের কিছু বলতে পারি না ভয়ে। মাদ্রাসার আশপাশে একটু নজর দিলেই বুঝতে পারবেন আমরা কী অবস্থায় রয়েছি।
লালমাটিয়া স্টাফ কোয়াটার মাঠেও বিক্রি হচ্ছে মাদক। সেখানেও সন্ধ্যা হলেই মাদক বিক্রি হয়, টাউন হল সংলগ্ন ক্যাম্প থেকে মাদক ব্যবসায়ীরা সরাসরি লালমাটিয়া মাঠে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীদের এটি নিরাপদ স্থান বলে জানা যায়।
লালমাটিয়ার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, মাদকদ্রব্য অধিদফতরের এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কট্টর নজর দেওয়া হোক, লালমাটিয়া এলাকায় শত শত ভদ্রলোক বসবাস করেন। এখানে ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা তেমন কোনো অবনতি হয়নি কিন্তু মাঠের আশেপাশে অনেকেই মাদক সেবন এবং বিক্রি করে থাকে। মাদকদ্রব্য ও প্রশাসনের নজর বাড়ানোরও অনুরোধ করেন এসব বাসিন্দারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য অধিদফতরের (অপারেশন গোয়েন্দা) ডিআইজি তানভির মমতাজ, খোলা কাগজকে মুঠোফোনে বলেন, আপনি যে এলাকার কথা বলছেন এবং যে কয়েকটি মাঠের কথা উল্লেখ করেছেন এসব এলাকয় একাধিক অভিযান হয়েছে, এখন যেহেতু আবারো মাদক বিক্রি বেড়ে যাচ্ছে সেক্ষেত্রে আমাদের টিম আরো বাড়ানো হবে এবং ওই এলাকাগুলোতে নজরদারি করা হবে।
তিনি আরো বলেন, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের আশেপাশে মাদক বিক্রি হয়, আমরাও নিয়মিত অভিযান চালিয়ে থাকি। এখন যেহেতু বেড়ে গেছে সেক্ষেত্রে মাদকদ্রব্যের কর্মকর্তারা ওই এলাকটি নজরে রাখবে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হবে নিয়মিত অভিযানের আওতায় আনা হবে।
কেকে/এমএস