গত জুলাইয়ে বিশ্বের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক ঘটনা ঘটে গেছে বাংলাদেশে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা গানের লাইনের মতো সে ঘটনা দেখে মনে হয়, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। আসলেই এমন একটি দেশ বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। যেখানে একটি দেশের সরকারবিরোধী জনগোষ্ঠী দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে এমনভাবে ব্যবহার করেছে যা ইতিহাসে শেষ কবে ঘটেছে খুঁজে বের করতে হয়। ১৮-২০ জুলাই যেভাবে নির্বিচারে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে, তা ভবিষ্যতে কোথাও ঘটবে কিনা সে সন্দেহও আছে। আর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অস্ত্রের মুখে ছাত্র-জনতার অকুতোভয় লড়াইও দুনিয়ায় কম ঘটেছে। একের পর এক গুলিতে শহিদ হওয়ার পর, সে জায়গায় আবার ছাত্র-জনতার রুখে দাঁড়ানোর ঘটনাও বিরল।
ছাত্ররা সাধারণ কোটা সংস্কার আন্দোলনের জন্য রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু যখন তাদের হত্যা শুরু করল পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনী, তখন তাদের অভিভাবক, পাড়ার নারী-পুরুষ সবাই নেমে এলো। পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন দেশে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এমন দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এটা ঘটেছে নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে। আর সেই লড়াইয়ে জয় হয়েছে জনগণের। স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী তিনি শেষ মুহূর্তেও রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে জনগণের বুকে গুলি চালানোর পক্ষে ছিলেন। যারা গুলি চালাতে রাজি হয়নি, তাদের ভর্ৎসনা করেছেন। কিন্তু বাহিনীগুলো আর কত গুলি চালাবে। তাদের কারও কারও অস্ত্র, গোলাবারুদের মজুত ফুরিয়ে এসেছিল। কেউ থেমে যায়, আর কত মানুষ তাদের মারতে হবে এ ভয়ে। আর সবকিছু ঘটে যায় অল্প কয়েক দিনে। হিসাব করলে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট এ সময়ের মধ্যে।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়া এবং নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা দিক থেকে প্রশ্ন ওঠে এ ক্ষমতা পরিবর্তনকে রাজনৈতিকভাবে কোন নামে অভিহিত করা হবে, অভ্যুত্থান না বিপ্লব?
প্রথমত বিপ্লব বলতে মার্ক্সবাদে আমূল পরিবর্তনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে ক্ষমতা দখলকে বুঝানো হয়। এ ক্ষমতা দখল করে থাকে প্রলেতারিয়েতরা অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণি। এ ক্ষেত্রে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন করলেই হয় না। উৎপাদন সম্পর্কের দখল নিতে হয়। বিপ্লবের সেজন্য রাষ্ট্র এবং কারখানার মালিকানা বদল। সেখানে সংগঠিত রাজনৈতিক দল বা জনতা ক্ষমতা দখলের জন্য দীর্ঘ লড়াই করে। কীভাবে তারা ক্ষমতায় যাবে এবং গিয়ে কী করবে তার ছক আঁকা থাকে। আর বিপ্লবের পর পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবহার পরিবর্তে কাজ করবে ‘কমিউন’। যারা এ কমিউন একই সঙ্গে সংসদ, সংস্থা, নির্বাহী এবং আইনসভা হিসাবে কাজ করবে এবং একে কর্মক্ষম বা ক্রিয়াশীল হতে হবে। অতএব, বিপ্লব বলতে যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে, তা জুলাইয়ে বাংলাদেশে ঘটে নাই।
তাহলে জুলাইয়ে কী ঘটেছে? এটাকে বলতে হবে অভ্যুত্থান হয়েছে। তবে এমন অভ্যুত্থান যাকে কোনো শর্ত দিয়ে ধরা যায় না। হঠাৎ করে ঘটে গেছে। ঘটে যাওয়ার পেছনে যে মানসিকতা কাজ করেছে মানুষের মধ্যে, তা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত নানা শ্রেণিপেশার মানুষের কথায় পাওয়া যায়। যেমন একজন রিকশাচালক আন্দোলন চলাকালে বলছিলেন, ছাত্রদের রক্ত তারা দেখে ফেলেছেন, যা দেখার পর তারা আর কোনো বাধা মানতে রাজি ছিলেন না। তারা এ রক্তের বাঁধনে একে-অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তখন তারা আহত ছাত্রদের হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। ৪ আগস্ট শহিদ নাফিজের শরীর রিকশার পাদানিতে ঝুলে থাকার দৃশ্য গোটা আন্দোলনেরই একটি প্রতীক হয়ে উঠে ছিল। এ আন্দোলনে এখন পর্যন্ত ২৪ জন রিকশাচালকের শহিদ হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ছাত্ররা মরেছে অকাতরে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও শহিদ হয়েছেন। আবার অন্যান্য পেশার মানুষ তো রয়েছেই। আমরা দেখেছি সমাজে অভিজাত বলে পরিচিত ডিওএইচএস এলাকার বাসিন্দা, সাবেক সেনা কর্মকর্তার পরিবারের বিপুলসংখ্যক সদস্য এ আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। বিশেষত ৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে বিরাট এক মিছিল বের হয়। প্রশ্ন হলো, তারা কীসের ভিত্তিতে এভাবে হঠাৎ একজোট হয়ে গেল?
এর সহজ উত্তর হলো নীপিড়ন। মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় ব্লক রেইড দেওয়ার প্রতিবাদে সেখানকার বাসিন্দারা রাস্তায় নেমে আসে। শোনা যায়, ওই ব্লক রেইডে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও ছিল। যা স্থানীয়রা মেনে নিতে পারেনি। আরেকটি হলো প্রাণক্ষয়। যার প্রমাণ আমরা পাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের গুলি করা নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালকে দেওয়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক সদস্যের উক্তি থেকে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা সেদিন বলেন, ‘গুলি করে করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’
অর্থাৎ গুলি করেও ছাত্র-জনতাকে থামানো যাচ্ছে না। মানুষ যেন পাগলপারা হয়ে গেছে। তারা আর মরতে ভয় পাচ্ছে না। যেহেতু আবু সাঈদকে মারা হয়েছে অন্যায়ভাবে, এর বিচার করতে হবে। প্রথমে তারা বিচার হিসাবে পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমা দাবি করল। ক্ষমা না চেয়ে নাটক করায় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে তার পদত্যাগ দাবি করা হয় ৩ আগস্ট। আওয়ামী লীগ তখন আওয়াজ তোলে এই এক দফাকে তারা কবর দিয়ে দেবে, সাত মিনিটে রাস্তা খালি করবে ইত্যাদি। ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর। সেদিন হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক। ৫ আগস্ট যার প্রতিবাদে মার্চ টু ঢাকা আহ্বান করা হয়। সেখান থেকে গণভবন অভিমুখে মিছিল করা হবে বলে জানানো হয়। আর ৫ তারিখ কী হয়েছে সেটা সবাই জানে।
এ কয়েক দিনের আন্দোলনে কোথাও সংগঠিত দাবি-দাওয়া, জনগণের আশা বা অভিপ্রায় জানা যায় না। তারা সহজ অর্থে রক্তের টানে এক হয়। অবশ্যই এর পেছনে আরও ইতিহাস আছে। দীর্ঘ পনেরো বছর আওয়ামী লীগ যে জুলুমের শাসন চাপিয়ে দিয়েছে, তা থেকে মানুষ মুক্তি চেয়ে ছিল। তাদের দুঃশাসন, লুটপাট, জনগণকে হেয় করা, গুম-খুন; অনেক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা তাদের ছিল। তবে প্রাথমিক দাবি ছিল শেখ হাসিনাকে বিদায় করা। তারপর কীভাবে কী করা হবে, সেটা মোটেও জানা ছিল না বা উল্লেখ করা ছিল না কোথাও। এখন দেশকে জনকল্যাণমুখী করার জন্য কী কী বন্দোবস্ত করতে হবে, সেটা অবশ্যই আলোচনার বিষয়। যা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের তর্ক-আলোচনা চলছে। গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য যা সুস্থতার লক্ষণ। জনগণ কথা বলতে চেয়েছে মন খুলে। যা সংবিধান সংস্কার ছাড়াই সম্ভব হয়ে গেছে। কথা বলতে পারলে আর কী লাগে বাংলাদেশিদের?
আরেকটি বিষয় আমরা জনগণের অভিপ্রায় হিসাবে দেখেছি গ্রাফিতি এবং দেওয়াল লিখনে। ৫ আগস্টের পর থেকে ছাত্রছাত্রীরা সড়কে ট্রাফিক কন্ট্রোলের পাশাপাশি মেট্রোরেলের পিলার থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি দেওয়ালে গ্রাফিতি এঁকেছে, লিখেছে তাদের মনের কথা। এ দেখে মনে হয়েছে, তারা রাষ্ট্রকে, নিজের দশকে ক্লেইম করছে। দেশটা কারও বাপের না, সবার-সেটা লিখে লিখে বুঝিয়ে দিয়েছে মনে মনে। দেশটাকে হাজারও শহিদের রক্তে তারা নিজের করে পেয়েছে। ফলে জনগণের অভিপ্রায় হিসাবে আরেকটি টপিক আমরা সারকমাসটেনসিয়াল এভিডেন্স হিসাবে পাচ্ছি।
এর বাইরে সংবিধান, নির্বাচন কমিশন বা অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রমের কাজ চলমান। জনগণের যে এসব সংস্কারের বিষয়ে সায় আছে তা পরিষ্কার। সবচেয়ে জরুরি হলো পুলিশ বাহিনীকে সংস্কার করা। শুরুর দিকে তারা একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকলেও এখন ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। তাদের আচরণ, পেশাদারি মনোভাব ভালো লাগছে। বিচার বিভাগ স্বাধীন করার প্রক্রিয়া জটিল। তবে সেটিও হবে নিশ্চয়। অথর্ননৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর। জিনিসপত্রের দাম অত্যাধিক। সরকার বলছে তাদের আরও কিছু সময় দরকার অর্থনীতির লাগাম ধরতে। আমরা তাদের ওপর আস্থা রাখছি। আর বিগত পনেরো বছরের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণ সবচেয়ে বেশি যে দাবিটি জানিয়ে আসছিল, ভোটাধিকার। সে দিকে মনোযোগ ধরে রাখতে হবে আমাদের। আমরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এগোতে চাই। যদি কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের চেতনার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারে, তাহলে তার দায় তাকে নিতে হবে। কিন্তু সব কিছুর নিষ্পত্তি ঘটতে হবে রাজনৈতিক ভাবে।
কেকে/এমআই