মাগুরায় ধর্ষণ ও নির্মম নির্যাতনের শিকার আট বছরের শিশু আছিয়া মারা গেছে। তার মৃত্যুতে কাঁদছে সারা দেশ। ফেসবুকে আবেগক্ষুব্ধ মানুষ এ মৃত্যুতে কান্না করছে, অপরাধীদের দ্রুত বিচার চাইছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীরসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ শোক জানিয়েছেন। দুপুর ১টায় তার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে শিশুটির মরদেহ মাগুরায় নেওয়া হয়। সেখানে জানাজার পর তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে ধর্ষণে অভিযুক্তের বাড়িতে গতকাল রাতে জনতা আগুন দিয়েছে।
মাগুরার সেই শিশুটিকে বাঁচানো গেল না
মাগুরার সেই শিশুটিকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর একটায় মৃত ঘোষণা করা হয়। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগে তার মৃত্যু হয়।
কর্নেল নাজমুল হামিদ বলেন, সকালবেলা দুই দফায় শিশুটির ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ (আকস্মিকভাবে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া) হয়। সিপিআর দেওয়ার পর তার হৃদস্পন্দন ফিরে এসেছিল। কিন্তু দুপুর ১২টায় তার আবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। এ দফায় সিপিআর দেওয়ার পরও তার হৃদস্পন্দন ফেরেনি। দুপুর একটায় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানানো যাচ্ছে, মাগুরায় নির্যাতনের শিকার শিশুটি দুপুর একটায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। সিএমএইচের সর্বাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা প্রয়োগ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
শিশুটির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। শিশুটির শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর সমবেদনা জানায়। যে কোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
মাগুরায় যৌন নির্যাতনের শিকার মারা যাওয়া শিশুটির মা বলেছেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে যারা খারাপ কাজ করেছে তাদের ফাঁসি চাই।’
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) সামনে শিশুটির মা গণমাধ্যমকে এ দাবি জানান।
মাগুরায় জানাজা ও দাফন সম্পন্ন
শিশুটির মরদেহ সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে মাগুরায় পৌঁছায়। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মরদেহ বহন করা হেলিকপ্টারটি মাগুরা স্টেডিয়ামে অবতরণ করে। পরে সন্ধ্যা সাতটায় শহরের নোমানী ময়দানে শিশুটির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
শিশুটির মরদেহের সঙ্গে হেলিকপ্টারে শিশুটির মা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার মাগুরায় যান। পরে উপদেষ্টা ফরিদা আখতার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা রাষ্ট্র বা সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। কারণ এত ছোট্ট বাচ্চা একটা মেয়ের ধর্ষিত হওয়া মেনে নেওয়া যায় না, এটা কারও জন্য মেনে নেওয়া যায় না। শিশুটি (নাম) আমাদেরই মেয়ে। কাজেই আমরা সেভাবেই দেখছি।’
সন্ধ্যায় প্রায় একই সময়ে আলাদা একটি হেলিকপ্টারে মাগুরায় আসেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম ও খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক।
শিশুটির চাচা (বাবার ফুফাতো ভাই) বলেন, ‘আজ দুপুরে আমরা মৃত্যুর খবর পাই। এলাকার গোরস্থানে দাফনের জন্য কবর খোঁড়ার কাজ চলছে। আমরা এই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
শিশুটির মৃত্যুর পর বাড়িতে স্বজনদের ভিড়
শিশুটির মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর বাড়িতে মাতম চলছে। খবর পেয়ে এলাকাবাসী ও আত্মীয়স্বজন শিশুটির বাড়িতে গিয়ে ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছেন।
গতকাল দুপুরে জেলার শ্রীপুর উপজেলায় শিশুটির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা ও ছোট বোন বাড়িতে আছেন। মা ও বড় বোন শিশুটির সঙ্গে ঢাকায় আছেন। শিশুটির মৃত্যুর খবরে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন, এলাকাবাসী ও গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় করছেন। ঘটনার পর শিশুটির বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মেয়ের মৃত্যুর খবরে তিনি চুপচাপ হাঁটাহাঁটি করছেন, কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না।
শিশুটির এক আত্মীয় বলেন, ‘ওর বাবা নির্বাক হয়ে গেছে। সকাল থেকে কিছু খাননি। তাকে কিছুই খাওয়ানো যাচ্ছে না। লোকজনের ভিড়ে সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
বাড়িতে ভিড় করা এলাকাবাসী ও স্বজনেরা বলছেন, দুপুরের পর তারা শিশুটির মৃত্যুর খবর জানতে পারেন। শিশুটির সঙ্গে এতটাই নির্মমতা হয়েছে যে অচেতন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, এরপর আর চেতনা ফেরেনি। তারা এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন।
আছিয়ার মৃত্যুতে সবাই শোক জানাচ্ছেন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিশুটির শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছে। যে কোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিশুটির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটির মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি অপূর্ব জাহাঙ্গীর জানান, প্রধান উপদেষ্টা নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন।
সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার আগামী সাত দিনের মধ্যে শুরু হবে।
মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)।
এক শোকবার্তায় মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান উপদেষ্টা।
মাগুরায় নরপশুদের নিপীড়নের শিকার শিশুটির মৃত্যুর খবরে শোক জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে শিশুটির মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক শোক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘মাগুরার কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা ওই শিশুটির ওপর দিয়ে গিয়েছিল। ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় সংগ্রাম করে শিশুটি জগতের মায়া ছেড়ে আমাদের কতটা লজ্জা দিয়ে ও কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’
সাধারণ মানুষের ক্ষোভে ভরে গেছে নেট দুনিয়ায়
সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। নেটিজেনরা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। সাইফুল ইসলাম সাইফ লিখেছেন, ‘আল্লাহ বাচ্চাটাকে জান্নাতবাসী করুক। সঙ্গে সঙ্গে অন্যায়ের সঠিক বিচার করা হোক। শুনলেও কটু মনে হয়। তারপরও আপন বোন জামাই ও তার মুরব্বি তালই একসঙ্গে বিকৃত যৌনাচার করতে পারাটা সন্দিহান আমি। দিনশেষে মেয়েটিই ভিক্টিম। সঠিক তদন্ত আশা করি। কারণ ভিক্টিম মেয়েটির বোনকে সন্দেহের মনে হয়েছে। সঠিক তদন্ত ও বিচার একান্ত কাম্য।’
বায়জিদ হোসেন সাদ লিখেছেন, ‘মেয়েটি আর নেই! দেশের আরো একটি কলঙ্কিত অধ্যায়।’
তাহমিনা শিল্পী লিখেছেন, ‘মারা গেল, মেয়েটি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হিংস্র হায়েনা তোমাকে বাঁচতে দিল না। তোমাকে নিয়ে কেউ কেউ নোংরা রাজনৈতিক খেলা খেলল। পৃথিবীর নরক রূপটা তুমি দেখে গেলে। তোমার যন্ত্রণা অভিশাপে রূপ নিক, ওদের পুড়িয়ে দিক। সুপ্রিয় আইনপ্রয়োগকারী, আর কবে বিচার করবেন আপনারা?’
সাদিক খান লিখেছেন, ‘অন্তত ধর্ষিতা হবার ভয় সাথে নিয়ে মেয়েটাকে আর বাঁচতে হলো না বাংলাদেশে। মরেও বেঁচে গেলো মেয়েটি।’
মো. আবু সালেহ মুসা লিখেছেন, ‘সবশেষে জীবনের কাছে হার মানতে হলো শিশুটিকে। যারা অনলাইনে বহুবার শিশুটিকে মেরে ফেলেছিলেন, তারা খুশি তো?’
শব্দনীল লিখেছেন, ‘মাগুরার সেই মেয়েটি আর বেঁচে নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। অথচ ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে বানচাল করা হলো। কারা করলো? কেন করলো? কাদের স্বার্থে করলো? এরা কারা?’
আলমগীর মাসুদ লিখেছেন, ‘অতঃপর জীবনের সঙ্গে এক সপ্তাহ লড়াই করে শিশুটি মারা গেলো কিছুক্ষণ আগে! ধর্ষকের জয় হলো। ৮ বছর বয়সী এই মেয়ের জন্য একদিন উপোস ছিলাম। দুইদিন ছিলাম আহত। এখন তার মৃত্যু সংবাদে চোখ আমার টলমল করছে। মনে হচ্ছে আমার বাচ্চাটা চিরনিদ্রায় গেছে।’
তারকাদের ক্ষোভ আর ভালোবাসায় আছিয়া
আছিয়ার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সিয়াম আহমেদ লিখেছন, ‘আছিয়া, তুমি ঘুমাও মা। যে অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে তোমাকে যেতে হয়েছে, আল্লাহ নিশ্চয়ই এর বিচার করবেন, এই জমিনেই করবেন। জান্নাতের মেহমান হিসেবে শান্তিতে এখন ঘুমাও, মা।’
শোক জানিয়ে সংগীতশিল্পী রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা লিখেছেন, ‘বেহেশতের ফুল আছিয়া, বেহেশতে চলে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ।’
তমা মির্জা লিখেছেন, ‘শোনেন, পশু ধরে রেখে দেয় না মেরে ফেলে, আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলতে হয় রেখে দিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াতে হয় না। দশ/বিশজন পশুরূপী অমানুষ না থাকলে আমাদের দেশের জনসংখ্যা কমবে না। ধর্ষক কেন বেঁচে থাকবে? হয় সঙ্গে সঙ্গে মারেন, না পারলে সাধারণ জনগণের কাছে দিয়ে দেন, কিন্তু বাঁচিয়ে রেখেন না।’
ইয়ামিন হক ববি লিখেছেন, ‘মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটি আর নেই! আমরা বাকরুদ্ধ ও বিক্ষুব্ধ! আমরা শিশুটির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী ও লজ্জিত!’
রুকাইয়া জাহান চমক অপরাধীদের ফাঁসি চেয়ে লিখেছেন, ‘আগামী তিন দিনের মধ্যে আছিয়ার ধর্ষককে প্রকাশ্য দিবালোকে জনসম্মুখে ফাঁসি দেয়া হোক। ধর্ষণের বিচারে দৃষ্টান্ত তৈরি করুক বাংলাদেশ।’
ইরফান সাজ্জাদ সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিয়ে লিখেছেন, ‘আল্লাহ আপনি বিচার কইরেন।’
শাহরিয়ার নাজিম জয়ের কথায়, ‘আছিয়ার মৃত্যু শুধুই একটা মৃত্যু নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর প্রতিটি নারীর আজীবনের অভিশাপ। প্রতিটা সুস্থ পুরুষের নিজের মেয়ের কাছে আমৃত্যু ছোট হয়ে থাকা।’
শাহনাজ খুশি লিখেছেন, ‘এ শহরে আর কোনো কন্যার জন্ম না হোক। মাতৃহীন, ভগ্নিহীন, কন্যাহীন মরুভূমি হোক এদেশ। কুলাংগারের আবাদ হোক!
ফারহান আহমেদ জোভান লিখেছেন, ‘আমাদের মাফ করে দিও আছিয়া। আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না।’
কেকে/এআর