ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। ওইদিনই ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। দীর্ঘ ১৫ বছর পর স্বৈরাচারমুক্ত হয় বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না ভারত। নিজেদের ঘনিষ্ঠ মিত্র শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের মসনদে ফেরাতে নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক সবভাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশটি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ভারতীয় বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং র’-এর অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। জনশ্রুতি আছে, হাসিনা সরকারের হয়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা র-ই নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর ভারতীয় সেই আধিপত্য ভেঙে পড়ে। বাংলাদেশ থেকে একপ্রকার বিতাড়িতই হয় তারা। তারপরই থেমে নেই তাদের ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশে নিজেদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে নানা ধরনের সাজানো আন্দোলনের উসকানিসহ গোপন কিলিং মিশনেও নামছে ভারতীয় এ গোয়েন্দা সংস্থাটি।
সম্প্রতি ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মাঠে নামার চেষ্টা করে ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের কুশীলবরা। যান নেতৃত্ব দেন স্লোগানকন্যা নামে খ্যাত লাকি আক্তার। অভিযোগ আছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ সম্পূর্ণ র’য়ের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে। তবে গণজাগরণ মঞ্চের পুনরুত্থান ঠেকিয়ে দেয় ছাত্র-জনতা।
এ ছাড়া সুব্রত বাইনসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে ওঠাও নতুন করে শঙ্কা ছড়াচ্ছে। সুব্রত বাইনের সঙ্গে ভারতীয়দের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তারা বলছেন, বাংলাদেশে নানাভাবে অপতৎপরতা চালাচ্ছে ভারতীয়রা। সম্প্রতি বিভিন্ন আন্দোলনে তাদের এ দেশীয় এজেন্টরা যুক্ত হয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন। তারা আরো আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশে গোপন কিলিং মিশন পরিচালনা করতে পারে র’। তারই পূর্ব নমুনা হচ্ছে সুব্রত বাইনসহ শীর্ষ সন্ত্রসীদের প্রকাশ্য তৎপরতা।
এ বিষয়ে সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, বুধবার রাত প্রায় ৮টার দিকে হাতিরঝিল থানাস্থ মগবাজার টিএন্ডটি কলোনির মসজিদের সামনে কিছু সন্ত্রাসী অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়ার সময় এলাকার মুসল্লিগণ তাদের ধাওয়া করেন, একপর্যায়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসী একজন সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করে মারধর করে। জানা যায় ওই সন্ত্রাসীর নাম মাহফুজুর রহমান বিপু এবং সে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং শ্যুটার।
পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে টিএন্ডটি কলোনির মাঠ থেকে সন্ত্রাসী বিপুর ফেলে দেওয়া অস্ত্র উদ্ধার করে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সন্ত্রাসী বিপুর বিরুদ্ধে মামলা নিতে গড়িমসি করে। বরং পুলিশ মাহফুজুর রহমান বিপুকে আহত অবস্থায় তাদের গাড়িতে তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে গ্রেফতার না করে স্বজনদের জিম্মায় ছেড়ে দেয়। তিনি আরো লিখেছেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন দেশের অভ্যন্তরে হাইভ্যালু টার্গেট এসাসিনেশনের পরিকল্পনা করছে, এমন তথ্য থাকার পরও কেন হাতিরঝিল থানার ওসি ও সংশ্লিষ্ট জোনের ডিসি মামলা ও গ্রেফতার না করে মাহফুজুর রহমান বিপুকে তার স্বজনদের জিম্মায় ছেড়ে দিল?
জুলকারনাইন সায়ের এর আগে বাংলাদেশে র-এর এজেন্টদের তৎপরতা নিয়ে আরেকটি পোস্ট দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ভারতীয় বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং ‘র’-এর দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গত ৬ নভেম্বর ২০২৪ ঢাকায় আসেন। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের এনএসআই এবং ডিজিএফআই এই দুই সংস্থার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়া সুসম্পর্ক পুনঃস্থাপন। তথ্য-প্রমাণ যাচাই করে জানা গেছে, র’ কর্মকর্তারা মূলত ভারতের আইপিএস (ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস) কর্মকর্তা। আইপিএস হতে ২০০৭ সালে আশোক এবং ২০১৩ সালে কনজককে ডেপুটেশনে র’তে পাঠানো হয়। ইতঃপূর্বে আশোক কুমার সিনহা দুইবার বাংলাদেশে আসেন (৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ও ১০ নভেম্বর ২০২৩) কেবল ১ দিনের জন্য।
মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে গোয়েন্দা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতেই এই দুই কর্মকর্তার ঢাকায় আসা, কিন্তু বিধিবাম, আওয়ামী সরকারের সময় যে ধরনের অভ্যর্থনা পেয়ে তারা অভ্যস্ত এবার হয়েছে ঠিক তার উল্টো। এনএসআই এবং ডিজিএফআই' এর পক্ষ হতে র’ কর্মকর্তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয় যে, রুটিন সম্পর্কের বাইরে কোনো বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ নেই।
কেকে/এআর