তুচ্ছ কারণে মানুষের উপর চড়াও হচ্ছে মানুষ। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জন্ম দিচ্ছে নিত্যনতুন সহিংসতার। কখনো আবার প্রতিশোধের নামে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে জনসম্মুখে। এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও অপরাধমূলক ঘটনার দেখা মিলছে হরহামেশাই। যে কারণে সভ্য সমাজে কোমলমতি শিশু ও অসহায় নারী নির্যাতনসহ খুনখারাবি, নৃশংসতা, বর্বরতা ও নির্মমতার ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
বিশেষজ্ঞরা সমাজজীবনে এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দোষী ব্যক্তিদের যথাসময়ে বিচারের মুখোমুখি করতে না পারাকে দায়ী করছেন। একইসঙ্গে তারা ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়কেও দোষারোপ করছেন। তারা বলছেন, ঘুণে ধরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামাজিক অস্থিরতা তো আছেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। তাই বাড়ছে সুযোগসন্ধানী মনোভাব।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবেদা খাতুন বলেন, “মানুষ ছোটবেলা থেকে যদি বুঝতে শেখে কোনটা করা উচিত, আর কোনটা উচিত না। তবে একটা মোরাল ডেভেলপমেন্ট তৈরি হয়। মূলত উন্নতির সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে যে তারা অপরাধী হয়ে ওঠে। শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে তারা কোনকিছু ভয় না।”
আদালত পাড়ায় আসামির ওপর হামলা। চোর-ডাকাতকে গণপিটুনির নামে নির্দ্বিধায় আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন অনেকে।
হিউম্যান রাইটস সোসাইটির তথ্য বলছে, গত বছর ২০১টি গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৭৯ জন। এর মধ্যে গত ছয় মাসেই ঘটেছে ১৩০টি ঘটনা। আর শেষ দুই মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১০৭টি। এ ছাড়াও পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গত ৫ মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ১৮৯টি।
নোয়াখালীতে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে ডাকাতি : নোয়াখালী বেগমগঞ্জে এক বিধবা নারীর ঘরে ঢুকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল দুপুরের দিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন বেগমগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী মো. জাকারিয়া। এর আগে, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের লতিফপুর গ্রামের মলংঙ্গী বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের লতিফপুর গ্রামের মলংঙ্গী বাড়ির শাহানাজ আক্তারের বিল্ডিংয়ের প্রধান দরজা ভেঙে ৮-১০ জনের সংঘবদ্ধ ডাকাত বসতঘরে প্রবেশ করে। পরে তারা অস্ত্রের মুখে নারীকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে ৬টি মুঠোফোন, স্বর্ণ ২ ভরি, নগদ ৪০ হাজার টাকা, ৮ পিস শাড়ি, ১টি কম্বল, কসমেটিকস সামগ্রীসহ ১ কার্টুন খেজুর লুট করে নিয়ে যায়।
রংপুরে থানায় বাদীকে পিটুনি : রংপুর মহানগর পুলিশের একজন উপকমিশনারের বিরুদ্ধে ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগে থানায় মামলা করতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন এক ব্যবসায়ীর প্রতিনিধি। ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কর্তব্যরত কনস্টেবলের রাইফেল কেড়ে নিয়ে ওই ব্যক্তিকে বেধড়ক পিটুনির অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরের কোতোয়ালি থানায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একটি অভ্যন্তরীণ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিবলী কায়সার নগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওইদিন সকালে তাকে ‘অপরাধ’ থেকে প্রত্যাহার করে ‘ক্রাইম অ্যান্ড অপসে’ সংযুক্ত করা হয়।
রাজধানীতে বিভিন্ন এলাকায় ৮ জনকে গণধোলাই : রাজধানীতে পৃথক চুরি ও ছিনতাইয়ের সন্দেহে ৮ জনকে গণধোলাইয়ের পর পুলিশে সোপর্দ করেছে স্থানীয়রা। গত রোববার সকাল থেকে দুপুরে মধ্যে এসব ঘটনা ঘটে। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ আহত অবস্থায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছে।
যাত্রাবাড়ী থানার এসআই ফারজানা আক্তার জানান, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ছিনতাইকারী সন্দেহে তিন ভাইসহ চারজনকে গণধোলাই দেয় স্থানীয় জনগণ। তারা হলেন- রফিকুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম ও রিপন মিয়া। এ তিনজন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আবুল কালামের ছেলে। এ ছাড়া সোহাগ মিয়া নামের আরো একজনকে গণধোলাই দেওয়া হয়। মতিঝিল থানার এজিবি কলোনি এলাকায় এক মহিলার ব্যাগ নিয়ে পালানোর সময় গণধোলাইয়ের শিকার হয় তন্ময় (১৭) নামের একজন। চকবাজার থানার বকশিবাজার এলাকায় কাগজের কার্টুন চুরির অভিযোগে অপু ও আলী নামের দুজনকে আটক করে গণধোলাই দেয় স্থানীয়রা। ভাটারা থানার এসআই কামরুজ্জামান বলেন, সোলমাইদ এলাকায় সকালে একটি বাসার ৪র্থ তলা থেকে মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ও ল্যাপটপ চুরি করে পালাতে গিয়ে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েন মানিক মিয়া। তাকে স্থানীয়রা গণধোলাই দেয়। পরে পুলিশ উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুজনকে গণপিটুনি : রাজধানীর উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে আহত করার পর পায়ে দড়ি বেঁধে তাদের উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা ঘটেছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকার বিএনএস সেন্টারের সামনে ফুটওভারব্রিজের ওপরে এ ঘটনা ঘটে। একইদিন মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে গাজীপুরের টঙ্গীতে স্টেশনরোড এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, এক পথচারীর মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন ওই যুবক। এ সময় স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি তাকে ধরে ফেলেন। পরে তাকে স্টেশনরোডসংলগ্ন একটি ফাঁকা জায়গায় নিয়ে পিটুনি দেন উপস্থিত লোকজন।
এদিকে রাজধানীর কল্যাণপুরে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনির শিকার মো. জাবেরকে (৩৫) গত বৃহস্পতিবার কারাগারে পাঠিয়েছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সাজ্জাদ রোমন এ তথ্য জানান।
ছিনতাইকারীদের কবলে ঢাবি অধ্যাপক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক গত ১৫ জানুয়ারি রাতে টেকনিক্যাল মোড় থেকে ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় আসার সময় সিএনজি অটোরিকশার মধ্যে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। তিনি গত ১৫ জানুয়ারি রাত ১০টা ৫ মিনিটে গণভবনে মুঠোফোন ও ব্যাগপত্র কেড়ে নেয় দুই ছিনতাইকারী। এসময় একজন বলেন, ‘তুই এখনই দুই লাখ টাকা দিবি, নইলে তোর গলা কেটে দেব।’ তিনি তার এক আত্মীয়কে ফোন করে বলেন, ‘আমি একটা বিকাশ নম্বর দিচ্ছি। এখনই এক লাখ বিকাশ কর। তখন ছিনতাইকারীদের দেওয়া বিকাশ নম্বরে ৪৫ হাজার টাকা পাঠান অধ্যাপকের ওই আত্মীয়।
মব সন্ত্রাসের কারণে জনমনে ক্ষোভ : সিপিবি
মব সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে রহস্যময় নির্লিপ্ততা, উদ্যোগ গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স)। গতকাল সকালে রাজধানীর পল্টন মোড়ে ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশে রুহিন হোসেন এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ, খুন, নৈরাজ্য, সন্ত্রাস প্রমাণ করে দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। মাগুরার সেই শিশুর মৃত্যু লজ্জিত ও অপরাধী করে দেয়। ‘খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন : রুখে দাঁড়াও জনগণ’ শিরোনামে এই সমাবেশের আয়োজন করে সিপিবির ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটি।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, শাস্তির ভয় না থাকায় বাড়ছে এমন অপরাধ। অপরাধের মানসিকতা বদলাতে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে বাড়াতে হবে মানবীয় মূল্যবোধের চর্চা। সেইসঙ্গে গোষ্ঠীগত সংঘাত এড়িয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হতে হবে রাষ্ট্রকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব বলেন, এক ধরনের রিভেঞ্জ থিওরির মধ্যে আমরা আছি। কেউ অন্যায় করলে আইনানুযায়ী তার শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু মানুষ নিজেই আইনটা হাতে তুলে নিচ্ছেন। এটা ভবিষ্যতের জন্য এলার্মিং (সতর্ক বার্তা)।
কেকে/এআর