রাজধানীসহ সারা দেশে জাল নোটের ছড়াছড়ি। আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতরকে টার্গেট করে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে জাল টাকার চক্রগুলো বাজারে এখন ভীষণ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকার নোটের পাশাপাশি ২০ ও ৫০ টাকার জাল নোটও ছড়িয়ে দিচ্ছে চক্রগুলো। ছড়িয়ে পড়া এসব জাল নোটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতারা। তাদের মাঝে দেখা দিচ্ছে এক ধরনের আতঙ্ক।
এরই মধ্যে এ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলেন- সুমন (৩৮), সুলতানা (২৮) ও হানিফ গাজী (৪৮)। গতকাল শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন।
এর আগে, গত বৃহস্পতিবার কামরাঙ্গীচরের মাতবর বাজারের বুড়িগঙ্গা গণপাঠাগার সমাজকল্যাণ সংস্থার সামনে বেড়িবাঁধে চেকপোস্ট থেকে ওই তিন জনেকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ বলছে, রমজান ও ঈদকে টার্গেট করে বিপুল জাল নোট তৈরি করেছে চক্রটি। এর মধ্যে ৩০-৪০ লাখ টাকার সমপরিমাণ জাল নোট ইতোমধ্যে বাজারে ছেড়েছে। নিজেদের তৈরি বি-গ্রেড মানের ১ লাখ টাকার জাল নোট ৯ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করছে তারা।
ডিসি জসিম উদ্দিন বলেন, গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মাদবর বাজারের বুড়িগঙ্গা গণপাঠাগার সমাজকল্যাণ সংস্থার সামনে বেড়িবাঁধে চেকপোস্ট বসায় পুলিশ। দুপুর দেড়টার দিকে একটি অটোরিকশায় জাল টাকার ব্যবসায়ীরা সেখানে পৌঁছালে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করে। পরে সুমন, সুলতানা ও হানিফ গাজীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেহ তল্লাশি করে ১ হাজার ও ৫০০ টাকার মোট চার লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, গ্রেফতার ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একই দিন বিকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলীর গ্যাসলাইন এলাকায় সুমনের ভাড়া বাসা থেকে ১৬ লাখ টাকার জাল নোট, একপাশে ছাপানো ৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকার জাল নোট, একটি সিপিইউ, একটি মনিটর, একটি কালার প্রিন্টার, জাল নোট তৈরির ১০টি ডাইস, তিনটি আঠার কৌটা, দুটি ফয়েল পেপার রোল, পাঁচটি কালির কৌটা, একটি রাবার কাটার, দুটি কাগজ ছিদ্র করার ভাইস ও জাল নোট তৈরির কাজে ব্যবহৃত এক বস্তা সাদা কাগজ উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতার আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে পুলিশ কর্মকর্তা জমিস উদ্দিন বলেন, ওই তিনজনই অভ্যাসগত জাল টাকা প্রস্তুতকারী। তারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের জাল নোট তৈরি করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করত। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কারও নাম না বললেও তারা জানিয়েছে বিভিন্ন জায়গায় সরবারহ করত নোটগুলো।
তাদের আদালতে পাঠানো হলে প্রত্যেকের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। ওই চক্রে আরো সদস্য আছে কিনা রিমান্ডে জানতে চাওয়া হবে বলেও জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট এক সূত্রে জানা গেছে, এ চক্রগুলোর তৎপরতা রুখতে সক্রিয় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। এরই মধ্যে জাল টাকা ও জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেফতার হয়েছেন চক্রের সদস্যরা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে আরো অন্তত এক ডজন কারবারির নাম। ওইসব সদস্যরাও রয়েছেন নজরদারিতে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেফতার করা হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, জাল টাকা ছাপানোর জন্য উন্নত মানের ল্যাপটপ, প্রিন্টার, হিট মেশিন, বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিন, ডাইস, জাল টাকার নিরাপত্তা সুতা, বিভিন্ন ধরনের দামি কালি, আঠা ও স্কেল কাটার ব্যবহার করে চক্রগুলো। এ ছাড়া গ্রাফিকস কাজের জন্য ওই চক্রে রয়েছে অনেক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। নিখুঁতভাবে টাকা ছাপতে তাদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। এরা টাকার জলছাপ থেকে শুরু করে অন্যান্য নিরাপত্তার সবই হুবহু নকল করছে। চক্রগুলো সারা বছর ঘাপটি মেরে থাকে। ঈদ ও পূজা টার্গেট করে তারা জাল টাকার নোট ছাপে। টাকা ছাড়াও এরা ডলার ও রুপি জাল করছে। জাল নোট তৈরির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেওয়া হয়। কিন্তু তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের একই কাজ শুরু করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, দেশের যে কোনো ধরনের উৎসব শুরুর আগে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকার কারবারিরা। এ চক্রের সদস্যদের প্রায়ই গ্রেফতার করা হয়। তারপরও তারা জামিনে বেরিয়ে ফের একই অপকর্মে লিপ্ত হয়।
তিনি আরো বলেন, এবারো ঈদকে ঘিরে চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে পুলিশও বসে নেই। তাদের শনাক্ত করে গোয়েন্দা জালে নেওয়া হয়েছে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেফতার করা হবে।
সূত্রে জানা যায়, শুধু ঈদ নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবমুখর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আগেও মার্কেটে কেনাকাটার সময় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে বিক্রেতাদের এসব জাল মুদ্রা গছিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিটি উৎসবের আগমুহূর্তে জাল নোট তৈরির চক্রগুলোর জাল টাকা নিখুঁত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা চলে। কারণ যে চক্রের টাকা যত নিখুঁত, তার টাকার দাম তত বেশি, বিক্রিও বেশি। প্রতি ১০০ পিস ১০০০ টাকার নোট অর্থাৎ এক লাখ টাকা তৈরিতে তাদের খরচ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। সেই টাকা তারা পাইকারি বিক্রেতার কাছে ৯ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। পরে পাইকারি বিক্রেতা প্রথম খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা, প্রথম খুচরা বিক্রেতা দ্বিতীয় খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় এবং দ্বিতীয় খুচরা বিক্রেতা মাঠপর্যায়ে সেই টাকা আসল এক লাখ টাকায় বিক্রি করছে।
শুধু তাই নয়, মাঠপর্যায়ে এ চক্রের কর্মীরা বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার মাধ্যমে এই জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে থাকে। জাল টাকা তৈরি থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে তারা এ কাজ করে থাকে। প্রথমে অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি, দ্বিতীয় পর্যায়ে এ টাকাগুলো যে অর্ডার দেয় তার কাছে পৌঁছে দেওয়া, তৃতীয় পর্যায়ে জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সারা বছর মাদকের লেনদেন, চোরাই পণ্যের কারবার, স্বর্ণ বেচাকেনাসহ বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনে জাল নোট চালিয়ে দেয় চক্রের সদস্যরা। অন্য পেশায় থাকলেও বেশি লাভের আশায় অনেকে এ পেশায় জড়িয়ে পড়ছে।
কেকে/এজে