ঢাকা, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪ | ১ কার্তিক ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভোল পাল্টাচ্ছেন হাসিনা আমলের সুবিধাভোগীরা

বিতর্কিতদের বদলি, পুলিশ বাহিনীতে অসন্তোষ

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
🕐 ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৫, ২০২৪

বিতর্কিতদের বদলি, পুলিশ বাহিনীতে অসন্তোষ

পুলিশ সদস্যদের অপেশাদার আচরণ এবং দলীয় লেজুরবৃত্তির কারণে মারাত্মক রকমের ইমেজ সংকটে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত এ বাহিনীটি। বিগত সরকারের আমলে পুলিশের সিংহভাগ কর্মকর্তা প্রশাসনের চেয়ে বেশি দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। ফলস্বরূপ গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে পুলিশের চেইন অব কমান্ড অনেকটাই ভেঙে পড়ে।

শৃংখলা ফেরাতে শীর্ষ পদে ব্যাপক রদবদল করে ছন্দে ফেরার চেষ্টা করলেও হাসিনা সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী ও প্রভাবশালী বেশ কিছু বিতর্কিত কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন করায় বাহিনীর অভ্যন্তরে ফের ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে। ফলে সেই স্থবিরতা কাটিয়ে পুলিশ এখনো স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরতে পারছে না।

পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপির একাধিক সূত্র জানায়, বাহিনীর কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তৎকালীন সরকারের তাবেদারি করে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন। তাদের এসব কর্মকাণ্ডে পুলিশ বাহিনী এতটাই বিতর্কিত হয়ে পড়ে যে জনগণের বন্ধু না হয়ে শত্রুতে পরিণত হয়। এরইমধ্যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দুই দিন পর পুলিশের আইজিসহ বেশ কয়েকটি শীর্ষ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসে নতুন মুখ। সেই ধারাবাহিকতায় সবগুলো মহানগর ও জেলায় জেলায় নতুন কমিশনার ও এসপিদের পদায়ন করা হয়।

কিন্তু নতুন পদায়নকৃতদের মধ্যে অনেকেই বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলনে সরকারের পক্ষে দলীয় ক্যাডারের মতো ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে সবশেষ জুলাই-আগষ্টে চলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তারা সরকারের লাঠিয়ালের মতো ভূমিকা পালনও করেছেন অনেকেই।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশের ডিআইজি জিল্লুর রহমান চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মোটা অঙ্কের টাকা অনুদান নিয়ে নির্ধারিত ছুটি শেষেও কর্মস্থলে না ফিরে অবৈধভাবে লন্ডনে বসবাস করেন। বিদেশে গিয়ে সময়মত না ফেরায় তখন তিনি সাময়িক বরখাস্ত হন। পরে তিনি চাকরিতে যোগদানের জন্য আবেদন করলে কর্তৃপক্ষ তার দাখিল করা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সঠিক না হওয়ায় তাকে পুনরায় চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শীর্ষ মহলে যোগাযোগ করে শেখ হাসিনা সরকার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন মর্মে চাকরিতে পুনর্বহাল হন। চলতি মাসের ৮ তারিখে তিনি (বিপি- ৭০৯৫০২৭৮৮০) উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক হিসেবে পুলিশ অধিদপ্তরে পদায়নপূর্বক ট্রাফিক এন্ড ড্রাইভিং স্কুল (টিডিএস) এ বদলি হন।

জানতে চাইলে ডিআইজি জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমার সন্তানের চিকিৎসার জন্য ছুটি নিয়ে লন্ডনে ছিলাম। তার চিকিৎসার জন্য অনেক সময়ের দরকার ছিল। কিন্তু আমাকে শুধু রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে বাধ্যতামূলক ছুটি অবসর দেওয়া হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পর নির্বাহী আদেশে আমি চাকরি ফিরে পাই।’

এদিকে পুলিশের আরেক ডিআইজি মো. নাজমুল করিম খান পুলিশ এসোসিয়েশনের সভাপতি হওয়ার লক্ষ্যে বেআইনিভাবে লিপ্ত রয়েছেন দাবি করে একটি সূত্র জানায়, বিসিএস ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কমিটি গঠন নিয়ে দুই পক্ষে তুমুল বাগবিতন্ডা ও হট্টগোলের রেশ ধরেই গত মাসের শেষ সপ্তাহে বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়। অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজি মনিরুল ইসলামকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর এবং সাধারণ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল আত্মগোপনে যাওয়ার পর নতুন কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ঐদিন রাতে আলোচনায় বসে শীর্ষ কর্মকর্তারা। শুরুতেই কর্মকর্তাদের একটি অংশ সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের অনুরোধ জানান। এসোসিয়েশনের সভাপতি পদে অতিরিক্ত আইজি পদের কর্মকর্তার বিধান থাকায় ১২তম ব্যাচের ক্যাডার ও র‌্যাবের মহাপরিচালক শহিদুল ইসলামের নাম প্রস্তাব করলে ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা তা সমর্থন করেন। এতে ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা অনাগ্রহ প্রকাশ করে।

এ সময় ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন পদোন্নতি না হওয়ায় তারা এখনো ডিআইজি হিসেবে রয়ে গেছেন। নিয়মিত পদোন্নতি হলে এতদিনে তারাও সবাই অতিরিক্ত আইজি হয়ে যেতেন। বর্তমান সরকার যেহেতু দ্রুত সংস্কার কাজ করছে সেহেতেু তারাও যে কোনো দিন অতিরিক্ত আইজি হয়ে যাবেন। এজন্যই এসোসিয়েশনের সভাপতি পদে তাদের ব্যাচের থেকে হলে কোনো সমস্যা নেই। মূলত ১৫তম ব্যাচের ডিআইজি নাজমুল করিম খান এসোসিয়েশনের সভাপতি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করার কারণেই তৈরি হয় বিতর্ক।

পুলিশ সদর দপ্তরের মিলনায়তনে সৃষ্ট বিভাজন এক পর্যায়ে উভয় পক্ষই একে অপরের দিকে তেড়ে যায়। উত্তেজনাকর পরিস্থিতির এক পর্যায়ে সব পক্ষ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. মইনুল ইসলামের কাছে যান। কিন্তু আইজিপিও কোনো সমাধান দিতে না পারায় কমিটি গঠন সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও হয়েছে।

একইভাবে আরেক ডিআইজি আলী হোসেন ফকির শেখ হাসিনা সরকার আমলে একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানায়। ফলে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থাকা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আলী হোসেন ফকিরকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদর দফতরে পদায়ন করা হয়েছে।

ডিএমপির একটি সূত্র জানায়, পুলিশের বিগত সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী অনেক কর্মকর্তাই তাদের পুরোনো খোলস পাল্টিয়ে এখন তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন লাভজনক পদে বদলি ও পদায়ন নিচ্ছেন। যদি এমনই হয় তাহলে বাহিনীর অভ্যন্তরে কোনোভাবেই শৃংখলা ফেরানো যাবে না। দ্বন্দ্ব-বিবাদ লেগে থাকার শঙ্কা থেকেই যায়। গুটিকয়েক সুবিধাভোগী কর্মকর্তার জন্য পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে না।

 
Electronic Paper