ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১ আশ্বিন ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পানি দূষণ ও আমরা

আফরিনা তানজিন
🕐 ৩:১১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৮, ২০২৪

পানি দূষণ ও আমরা

পরিবেশের উপাদানগুলোর মধ্যে সম্ভবত পানি প্রাণের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পানি ছাড়া যেমন প্রাণীকূল বাঁচতে পারে না তেমন প্রানের সৃষ্টিও কিন্তু এই পানি থেকেই হয়েছে। রসায়নে নোবেল জয়ী আমেরিকান বিজ্ঞানী প্রফেসর উরের মতানুসারে-আমদের পৃথিবী আদিম অবস্থায় সম্ভবত অ্যামোনিয়া, মিথেন এবং হাইড্রোজেনের মিশেলে পিণ্ডাকৃতির ছিল।

এই মিশ্রণকে যদি বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ এবং পানির সংস্পর্শে আনা যায় তাহলে অ্যামাইনো এসিড উৎপন্ন করা সম্ভব। এটা সর্বজন বিদিত যে, অ্যামাইনো এসিড হলো জীবনের প্রথম উপাদান।অর্থাৎ, পানির স্পর্শে জীবনের সূত্রপাত ঘটে। তাছাড়া সমস্ত জীবেরই দৈহিক গঠনে, প্রাণের স্পন্দনে এবং প্রাণ ধারণের জন্য পানির কোন বিকল্প নেই। জীবনের স্পন্দনে পানির উপস্থিতিই যে একমাত্র পূর্বশত তা আজ একটি চরম বৈজ্ঞানিক সত্য।

পানি যেমন প্রানীকে বাঁচিয়ে রাখে তেমন দূষিত পানি প্রাণিকূলের প্রাণ হন্তারক হতে পারে। বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ এর ধারা-২৮ অনুযায়ী ‘পানি দূষণ’ অর্থ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পানির ভৌত, রাসায়নিক বা জৈব গুনাবলির ক্ষতিকর কোন পরিবর্তনকে বোঝানো হয়।সহজ ভাষায় বলা যায়, পরিবেশে পানিতে দূষণকারী পদার্থ উপস্থিত থাকলে তাকে পানি দূষণ বলে।
বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বের একটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। আর পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পরিলক্ষিত হয় পানির উপর। পানি বলতে আমরা মিঠা পানি আর লোনা পানি বুঝলেও আজ আমরা মূলত আলোচনা করবো মিঠা পানির দূষণ নিয়ে এবং এই দূষণের ফলে পরিবেশের উপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে, তা নিয়ে।

পানি দূষণের ফলে জলজ বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশগত অবনতি ঘটে। যার ফলে বর্তমানে ভাটির দিকে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে জনস্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। পানি বাহিত রোগের প্রকোপে সারা বিশ্বে যত মানুষ আক্রান্ত হয় কিংবা মারা যায়, তাদের বেশিরভাগই ঘটে পানি দূষণের কারনে।
প্রাকৃতিক উৎস যেমন আর্সেনিক বা বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া মিঠা পানিতে দূষণ ঘটালেও মূলত মনুষ্যসৃষ্ট দূষণের ফলে পানি তার গুনগত মানের উপযোগিতা হারাচ্ছে। মনুষ্যসৃষ্ট যে সকল জৈব এবং অজৈব পদার্থ ব্যবহরের ফলে প্রতিনিয়ত পানির দূষণ হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিটারজেন্টস এর ব্যবহার; খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বর্জ্যর ব্যবহার যাদের মধ্যে রয়েছে অক্সিজেনের চাহিদাযুক্ত পদার্থ, চর্বি,গ্রিজের ব্যবহার; বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক এবং ভেষজনাশক রাসায়নিক যৌগের ব্যবহার; ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি দ্রব্য এবং প্রসাধনী দ্রব্যে উপস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ, শিল্পকারখানার উপজাত হিসেবে প্রাপ্ত রাসায়নিক বর্জ্য; নির্মায়মান অঞ্চল, গাছ কাটার ফলে মাটির ক্ষয় , জুম চাষ কিংবা ভূমি নিষ্কাশন অঞ্চল থেকে প্রবাহিত পলি যা পানিতে মেশে, যথেচ্ছ নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার প্রভৃতি প্রতিনিয়ত পানি দূষণ করে যাচ্ছে।

পানি দূষণ রোধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা খুব সংক্ষেপে আলোচনা করার সময় এসেছে। ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জাতীয় পানি নীতি ,১৯৯৯ এর নীতি ৪.১ এ নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নীতি ৪.২ এ পানি সম্পদ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা , নীতি ৪.৬ অনুযায়ী পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা, নীতি ৪.১৩ এ হাওড়, বাঁওড়, বিল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সম্পর্কে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেয়া আছে। তাছাড়াও জলধার সংরক্ষণ বিষয়ে বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ এর ধারা ২২ (১)অনুযায়ী নির্বাহী কমিটি যৌক্তিক মনে করলে সুপেয় পানির উৎস হিসেবে যে কোন দীঘি, পুকুর বা অনুরূপ কোন জলাধার সংরক্ষণের জন্য সুরক্ষা আদেশ দিতে পারে। তাছাড়াও জেলা পরিষদ আইন,২০০০ এর প্রথম তফসিলের ৬৫ নম্বর অনুযায়ী জেলা পরিষদ পানি নিষ্কাশন, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা , ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির জলাশয় সংরক্ষণ করবে। এমনকি জলাধারের সমগ্র পানি আহরণ বিষয়ে বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ এর বিধি ২৬ এ উল্লেখ আছে ব্যক্তি মালিকানাধীন জলধারা বাদে অন্য যে কোন জলাধারের সমগ্র পানি আহরণ করে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করা যাবে না।

জলধারা ভরাট বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর বিধি-৬(ঙ) তে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। পানি সরবরাহ ও পয়:নিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন-১৯৯৬ এর ২৪(১) নং উপধারা অনুযায়ী যে কোন ব্যক্তি তার মালিকানা বহির্ভূত সরকারি ভূ-উপরিস্থ পানি জনস্বার্থের বাইরে নিজ প্রয়োজনে সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কোন পাম্পিং ও পরিশোধন সুবিধাদি নির্মাণ করতে পারবেন না।বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন,১৯৯৫ এর ধারা-৩ নং অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পানির মান অনুসরণে পরামর্শ বা ক্ষেত্রমতে নির্দেশনা প্রদান করবেন।

এছাড়াও স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ এর দ্বিতীয় তফসিলের ১০(১) নম্বর অনুযায়ী পৌরসভা তার নিজস্ব আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে পৌরসভার স্বার্থে সাধারণ ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করবে।

উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর দ্বিতীয় তফসিলের ৫ ক্রমিক নম্বর ৪ অনুযায়ী ভূ-উপরিস্থ পানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের নির্দেশনা অনুসারে উপজেলা পরিষদ ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উম্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন,২০০০ এর ধার ৫ অনুযায়ী প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ, অন্য কোন ভাবে ব্যবহার করা, ভাড়া বা ইজারা বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করা যাবে না।

তাছাড়াও ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামো নির্মাণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০০০ এর ৬ (১) অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডকে পানি প্রবাহের উন্নয়ন কিংবা পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য জলপথ, খাল-বিল ইত্যাদি পুনঃখননের ক্ষমতা অর্পণ করা আছে।

একই ভাবে ভূগর্ভস্থ পানি অর্থাৎ, সুপেয় পানি ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ এর ধারা ১৯ অনুসারে সরকার কর্তৃক ভূগর্ভস্থ পানি আহরণের নিরাপদ সীমা নির্ধারণ এবং গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপনে বিধি প্রণয়নের নির্দেশনা দেয়া আছে। একই ভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ এর প্রথম তফসিলের ৬৫ নম্বর ক্রমিক এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০০০ এর ৬(১)(ছ) তে বিষদভাবে বলা আছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন আইন,২০১৮ এর বিধি ১১ তে উল্লেখ রয়েছে কি ভাবে কৃষিকাজে পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে ভূ-উপরিস্থ ও বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা হবে। তাছাড়াও জাতীয় পানি নীতি, ১৯৯৯ এর ৪.৭ অনুচ্ছেদে ‘পানি ও কৃষি’ শিরোনামে কৃষি ক্ষেত্রে পানির সঠিক ব্যবহার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া রয়েছে। জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ এর প্রথম তফসিলের ৩৯ ধারানুযায়ী জেলা পরিষদ কৃষিকাজে ব্যবহার্য পানি সরবরাহ, জমানো ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। শিল্পক্ষেত্রে শিল্প বর্জ্য পানিতে মিশে প্রতিনিয়ত পানি দূষণ করে যাচ্ছে। এ দূষণ রোধে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন,১৯৯৫ এর ধারা ১২(১)অনুযায়ী পরিবেশ গত ছাড়পত্র ব্যতিরেকে কোন এলাকায় বর্তমানে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না।

এতো সকল আইন-কানুন থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত পানি দূষণের মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে, যা সত্যিকারের আশঙ্কা জাগায়। প্রকৃতপক্ষে সরকার আইন করে দায়িত্ব শেষ মনে করে। কিন্তু এ ধরণের আইনের সঠিক প্রয়োগ আমাদের দেশে হয় না বললেই চলে। তাছাড়া একজন আইনের লোক এবং পরিবেশবিদ বলে হয়তো এ সকল আইন-কানুন আমাদের জানা আছে, কিন্তু দেশের আপামর জনতার এ ধরণের আইন নিয়ে খুব একটা ধারণা থাকার কথা নয়। তাই, পানি দূষণ রোধে আমরা নিজেরা যদি সচেতন না হই, তবে এমন আরো হাজারও আইন প্রণয়ন হলেও পানি দূষণের মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলবে।

লেখক : পরিবেশবিদ, ইক্ষান ল এসোসিয়েটস এন্ড কনসালট্যান্সি ফার্ম

 
Electronic Paper