ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১ আশ্বিন ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আলফ্রেড সরেনের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী

মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়, প্রাণভয়ে সাক্ষীদের পল্লীত্যাগ

নওগাঁ প্রতিনিধি
🕐 ৪:৩২ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৮, ২০২৪

মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়, প্রাণভয়ে সাক্ষীদের পল্লীত্যাগ

আজ ১৮ আগস্ট, বহুল আলোচিত নওগাঁর আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন এর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট ভীমপুর আদিবাসীপল্লিতে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন এই আদিবাসী নেতা। তবে ২৪ বছর আগে সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্মম ভাবে নিহত হলেও এখনো ওই মামলার কোন সুরাহা হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত ওই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।

আদিবাসী ব্যাক্তিদের অভিযোগ, জামিনে থাকা আসামিরা তাদের অব্যাহতভাবে হুমকি-ধমকি দেয়ায় ইতোমধ্যে অনেক আদিবাসী পরিবার ভীমপুর আদিবাসী পল্লী ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। বর্তমানে যে ১২টি পরিবার এখনো বসবাস করছে তারা ভূমিদস্যুদের ভয়ে জমিতে চাষাবাদ করতেও পারছেনা। ফলে চরম অভাব-অনটন ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যদিয়ে দিন অতিবাহিত করছে তারা। পল্লী ছেড়ে মামলার সাক্ষীরা চলে যওয়ায় মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার বাদী আলফ্রেডের ছোট বোন রেবেকা সরেন।

নওগাঁর ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, নিঝুম নিস্তব্ধ পল্লীটিতে আজ আর প্রাণচাঞ্চল্য নেই। ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে বসবাস করছে এখনো কয়েকটি পরিবার। রেবেকা সরেন ও তার ছোট ভাই মহেশ্বর সরেন শত হুমকির মধ্যে সেখানে রয়েছেন শুধু তার ভাইয়ের হত্যার বিচার দেখে যাওয়ার অপেক্ষায়। পল্লীর একধারে বাঁশ ঝাড়ের ছায়ায় অযতেœ পড়ে রয়েছে আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনের সমাধি। আদিবাসীদের চোখে মুখে রয়েছে আতঙ্কের ছাপ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার জামিনে থাকা আসামিদের অব্যাহত হুমকি-ধমকিতে ২৪টি পরিবারের মধ্যে বর্তমানে নতুন ও পুরাতন মিলে সেখানে বসবাস করছে মাত্র ১২টি পরিবার। বাকিরা জীবনের ভয়ে অন্যত্র চলে গেছে। নিহত আলফ্রেড সরেনের বৃদ্ধ বাবা গায়না সরেন আজ আর বেঁচে নেই। ২০০৮ সালে তিনি মারা যান। তিনিও অব্যাহত হুমকি-ধমকিতে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। আলফ্রেড সরেন হত্যাকান্ডের এক বছরের মাথায় তার মা ঠাকুরানী সরেন ছেলের শোকে মৃত্যু বরন করেন। আলফ্রেড সরেনের স্ত্রী জোছনা সরেন বর্তমানে তানোরে থাকেন। মেয়ে ঝর্ণা সরেনের বিয়ে হয়েছে। সেও স্বামী সন্তান নিয়ে মায়ের কাছে থাকে।

আলফ্রেডের ছোট বোন রেবেকা সরেন সেদিনের ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে ভূমিদস্যু হাতেম-গদাই গংদের সন্ত্রাসীদের হামলায় তাঁর ভাই আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন নৃসংশভাবে খুন হন। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসীরা ব্যাপক তান্ডব চালিয়ে আদিবাসী পল্লীর ১১টি পরিবারের বাড়িঘর ভাঙচুর লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময় তাদের হামলায় আদিবাসী মহিলা-শিশুসহ প্রায় ৩০ জন মারাত্মক আহত হয়। ঘটনার সময় আদিবাসীদের কয়েকজন শিশুকে সন্ত্রাসীরা পল্লীর পার্শ্ববর্তী পুকুরে নিক্ষেপও করেছিল। সন্ত্রাসীরা যখন আদিবাসী পল্লীতে হামলা চালায় তখন বেলা ১২টা। দিনটি ছিল শুক্রবার। ওইদিন নওগাঁ-মহাদেবপুর সড়কের চৌমাসিয়ার মোড়ে জুম্মার নামাজের পর ভীমপুরের আদিবাসীদের উপর ভূমিদস্যুদের অত্যাচারের প্রতিবাদে সমাবেশের আয়োজন করেছিল আদিবাসীরা। আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন সবকিছুর আয়োজন করে বেলা ১২টার দিকে বাড়িতে যান ভাত খেতে। পল্লীর অধিকাংশ পুরুষ ওই সময় চৌমাসিয়ার মোড়ে সমাবেশস্থলেই ছিল। গ্রাম ছিল পুরুষশূণ্য। আলফ্রেড বাড়িতে যেতেই সন্ত্রাসী বাহিনী সেই সুযোগটি নিয়েছিল। আলফ্রেড বুঝতে পেরে নিজের ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে আশ্রয় নেন। আলফ্রেড যে ঘরটিতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন সেই ঘরটিতে তারা আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে আলফ্রেডকে বের হতে বাধ্য করে। আলফ্রেড বেড়িয়ে আসামাত্র ঘাতক সন্ত্রাসীরা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তাকে যেকোন সময় হত্যা করা হতে পারে এমনটি আঁচ করতে পেরেছিলেন আলফ্রেড সরেন। সেদিন ওই সন্ত্রাসী ঘটনার সময় রেবেকা সরেন তাঁর ভাতিজী আলফ্রেড সরেনের মেয়ে ঝর্ণাকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে ছিল। তবে সন্ত্রাসীদের আঘাতে আলফ্রেডের স্ত্রী জোছনা সরেনের একটি চোখ মারাত্মকভাবে জখম হয়েছিল। পরবর্তীতে নিরাপত্তার জন্য সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে তা গুটিয়ে নেয়া হয়।

হত্যাকান্ডের আগের ৯আগষ্ট ২০০০ সালে নওগাঁর মুক্তির মোড় কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার পাদদেশে আন্তর্জাতিক আদিবসী দিবসে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাঁকে হত্যা করা হতে পারে এমন আশংকার বিষয় আলফ্রেড সরেন নওগাঁর সিপিবির নেতা ময়নুল হক মুকুল, মহসীন রেজাসহ আরো কয়েকজনকে বলেছিলেন সমাবেশের দিন । সবাই তাঁকে সতর্কভাবে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

এ্যাডভোকেট মহসীন রেজা জানান, হত্যাকান্ডের ঠিক আগের দিন ১৭ আগস্ট আলফ্রেড মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা দেওয়ান আমজাদ হোসেন তারাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে তাকে হত্যা করতে পারে এমন সন্দেহভাজন ১০ জনের নাম ছিল।

আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় তার ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ ৯১জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এর মধ্যে পুলিশ কয়েক জন আসামিকে গ্রেফতার করে। ওই সময় নওগাঁ দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষী গ্রহণ শুরু হয় এবং ৪১জন সাক্ষীর মধ্যে সেই সময় ১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জননিরাপত্তা আইন বাতিল করে। ওই সময় পলাতক শীতেষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই (বর্তমানে প্রয়াত) ও হাতেম আলীসহ ৬০ জনের অধিক আসামি জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে মামলাটি হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন। এর পর আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে।

এ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এ্যাড. মহসীন রেজা জানান, বর্তমানে আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলাটি অ্যাপিলেড ডিভিশন শুনানী অন্তে নিষ্পত্তি করে পুনরায় পূর্নাঙ্গ শুনানির জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনে প্রেরণ করা হয়েছে।

নওগাঁ জেলা সিপিবি’র সভাপতি মহসীন রেজা বলেন, ভূমিহীন ও আদিবাসীদের দখলকৃত জমি তাদের ফেরত দিয়ে পূর্ণ নিরাপত্তাসহ তাদের পুনর্বাসন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ওই এলাকায় প্রচুর সরকারি খাস সম্পত্তি আছে। যা আদিবাসী ও ভূমিহীনদের দখলে রয়েছে।

 
Electronic Paper